বিশ্ববাজারে গমের দাম গত কয়েক মাসে ধারাবাহিকভাবে কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে রাশিয়া, ইউক্রেন, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের মতো দেশগুলো গম রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা শুরু করায় দরপতন ঘটেছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। অথচ বাংলাদেশে সেই সস্তা বাজারের কোনো প্রভাবই পড়েনি। বরং দেশে আটা, ময়দা ও গমের দাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি আরও একবার নিত্যপণ্যের দামের আগুনে পুড়ছে।
সরকারের খাদ্য ক্রয়নীতি এবং আমদানি প্রক্রিয়া এখন জনঅভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু এজেন্ট ও আমলা আমেরিকা থেকে গম আমদানির নামে উচ্চমূল্যের চুক্তি করছে, অথচ রাশিয়া, ইউক্রেন বা ভারতের বাজারে একই মানের গম পাওয়া যাচ্ছে প্রায় অর্ধেক দামে। অর্থাৎ সরাসরি কম দামে কেনা নিষিদ্ধ করে জনগণের পেটের চাল, আটা ও গমের মাধ্যমে লুটপাটের এক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইউনুস সরকারের সময় থেকে এই সিন্ডিকেটভিত্তিক অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হয়েছে। সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আমদানি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে, যাতে কমিশন ও ঘুষের বিনিময়ে কোটি কোটি টাকার অবৈধ আয় নিশ্চিত করা যায়। এতে জনগণ শুধু পণ্যের অতিরিক্ত দাম দিচ্ছে না—তারা প্রকৃতপক্ষে এক ধরণের “খাদ্য কর” দিচ্ছে, যার সুবিধা পাচ্ছে গুটিকয়েক ব্যক্তি।
একই চিত্র দেখা যাচ্ছে চাল আমদানিতেও। ভারত থেকে সরাসরি চাল আমদানির অনুমতি না দিয়ে, দুবাই ও মিয়ানমারের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে চাল আনা হচ্ছে। এর ফলে ভারতীয় ভালো মানের চাল, যা আগে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় পাওয়া যেত, এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়। শুধু পরিবহন বা শুল্ক নয়—এই বাড়তি দামের বড় অংশ চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের কমিশন হিসেবে।
সরকার দাবি করছে, বিশ্ববাজারে সরবরাহ সংকট ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধিই দেশে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ার কারণ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ঠিক উল্টো—বিশ্ববাজারে যখন দাম কমছে, তখন দেশে তা বাড়ছে। অর্থাৎ, এখানে বাজারনীতির নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যই মূল কারণ।
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি—এই তিন গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আমদানি-নির্ভর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দেশের খাদ্যবাজারের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সরকারি ক্রয়াদেশ থেকে শুরু করে আমদানি বণ্টন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে কমিশন বাণিজ্য চলছে। সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতার অভাবের কারণে এই লুটপাট বছরের পর বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে।
ফলাফল হিসেবে আজ দেশের কৃষক তার উৎপাদিত ধান বা গমের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না, অথচ শহরের মানুষকে একই পণ্য কিনতে হচ্ছে দ্বিগুণ মূল্যে। বাজারের এই অস্বাভাবিক বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক অসাম্য নয়—এটি এক গভীর রাজনৈতিক সংকটের প্রতিচ্ছবি।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, যদি সরকার প্রকৃত অর্থে জনগণের পাশে দাঁড়াতে চায়, তাহলে সরাসরি উৎস দেশ থেকে গম ও চাল আমদানির অনুমতি দিতে হবে। একই সঙ্গে সরকারি ক্রয় ও সরবরাহ প্রক্রিয়া ডিজিটাল ট্র্যাকিং ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। তা না হলে সিন্ডিকেটের আধিপত্য ও দুর্নীতি আরও বেড়ে যাবে, যার ফল ভোগ করবে দেশের ১৮ কোটি মানুষ।
আজকের বাংলাদেশে গম, চাল ও আটার বাজার শুধু অর্থনীতির সূচক নয়—এটি নৈতিকতারও প্রতিচ্ছবি। জনগণের পেটের ক্ষুধা যদি লোভীদের কমিশনের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে, তাহলে সেই রাষ্ট্রের কোনো উন্নয়নই টিকবে না।

