২০০২ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে পরিচালিত হয় একটি বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত সামরিক অভিযান “অপারেশন ক্লিনহার্ট”। তৎকালীন সরকারের দাবি ছিল, এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল সমাজ থেকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নির্মূল করা। কিন্তু বাস্তবে এই অভিযান রূপ নেয় এক ভয়াবহ মানবাধিকার সংকটে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই অভিযানে শতাধিক মানুষ নিহত হন এবং কয়েক শত নাগরিক গুরুতর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন।
অভিযানে অংশ নেওয়া সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে বহু নির্যাতন, গুম ও মৃত্যুর অভিযোগ উঠলেও, ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে সরকার একটি দায়মুক্তি আইন পাস করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সব ধরনের বিচারিক পদক্ষেপ থেকে অব্যাহতি দেয়। এই আইন কার্যত ন্যায়বিচারের দ্বার বন্ধ করে দেয় এবং রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহারের এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
দীর্ঘ ২২ বছর পর আজও সেই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ন্যায়বিচারের আশায় প্রহর গুনছে। তারা দৃঢ় কণ্ঠে বলছে—রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নামে কোনো নাগরিককে হত্যা করা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পরিপন্থী। নিহতদের স্বজনদের দাবি, দায়মুক্তি আইন বাতিল করে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে এবং অপারেশনে জড়িতদের বিচার করতে হবে। তাদের মতে, কোনো আইনই মানবাধিকারের ঊর্ধ্বে হতে পারে না।
আইন বিশেষজ্ঞরাও একমত—দায়মুক্তি আইন সংবিধানের ২৬ ও ৩১ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। মানবাধিকারের মৌলিক নীতি হলো, কোনো অপরাধের দায় থেকে কাউকে চিরস্থায়ীভাবে মুক্তি দেওয়া যায় না, বিশেষ করে যেখানে প্রাণহানির মতো গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীও এমন দায়মুক্তি রাষ্ট্রীয় দায় এড়ানোর কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়।
আজ যখন বাংলাদেশ মানবাধিকার ও আইনের শাসনের পথে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করছে, তখন এই অধ্যায়টি বন্ধ রাখা অন্যায়। অপারেশন ক্লিনহার্টের মতো ঘটনার দায় নির্ধারণ ও বিচার শুধু ভুক্তভোগীদের জন্য নয়, রাষ্ট্রের নৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্যও অপরিহার্য।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকের জীবন, মর্যাদা ও নিরাপত্তা রক্ষা করা—ভয় দেখানো নয়। ইতিহাসের অন্যায়কে চেপে রাখা মানে ভবিষ্যতের অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই এখন সময় এসেছে দায়মুক্তির বেড়াজাল ভেঙে, অপারেশন ক্লিনহার্টে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ন্যায়বিচারের দাবি পূরণ করার।

