Thursday, October 30, 2025

খালেদা জিয়ার পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ থাকলেও শেখ হাসিনার পরিবারের নেই কেন

গত দুই দশকে বাংলাদেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্ত দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছে। বেগম খালেদা জিয়ার দুই পুত্র— তারেক রহমান ও আরাফাত “কোকো” রহমান আন্তর্জাতিকভাবে নথিভুক্ত অর্থ পাচার মামলার মুখোমুখি হয়েছেন। এসব মামলার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আদালতের নথি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের ফাইলিং এবং সিঙ্গাপুরে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ, যা তাদের অবৈধ আর্থিক লেনদেনের একটি স্পষ্ট প্রমাণপত্র সরবরাহ করেছে।

এই নথিগুলো একাধিক বিদেশি সংস্থার সহযোগিতায় করা হয়েছে। তারা বাংলাদেশের জন্য সম্পদ পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে, ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুললেও, এখন পর্যন্ত তেমন কোনো তুলনীয় প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি।

ফলস্বরূপ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জবাবদিহির প্রশ্নে দেখা যাচ্ছে এক বৈপরীত্যপূর্ণ বাস্তবতা যেখানে অভিযোগ অনেক, কিন্তু প্রমাণ ও ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে পার্থক্য স্পষ্ট।

আরাফাত “কোকো” রহমান: বিদেশি নথিপত্রে প্রমাণিত অর্থ পাচারের মামলা
বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো বাংলাদেশের সবচেয়ে নথিভুক্ত ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অর্থ পাচার মামলার অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের নথি অনুযায়ী, কোকোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় ৩০ লাখ মার্কিন ডলার সিঙ্গাপুরের একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাওয়া যায়। এই অর্থের উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত সিমেন্স বাংলাদেশ কর্তৃক প্রদত্ত ঘুষের অর্থ।

বিচার বিভাগের ২০১২ সালের অভিযোগপত্রে বলা হয়, “বিচার বিভাগ সিঙ্গাপুরে কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে সিভিল বাজেয়াপ্তকরণ মামলা দায়ের করে, যেখানে আনুমানিক ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জমা ছিল। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, এই অর্থগুলো সিমেন্স বাংলাদেশ কর্তৃক আরাফাত ‘কোকো’ রহমানকে প্রদত্ত ঘুষের ফল।”

এই মামলার ফলস্বরূপ, সিঙ্গাপুরের আদালত প্রায় ৮০০ মিলিয়ন টাকা (প্রায় ৯.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বাংলাদেশে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয়। দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর ২৮ আগস্ট ২০১৩ সালের প্রতিবেদনে এই রায় নিশ্চিত করে বলা হয়: “সিঙ্গাপুরের একটি আদালত… দেশের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে ৮০০ মিলিয়ন টাকা ফেরত দিতে নির্দেশ দিয়েছে… যা কোকো ২০০১–২০০৬ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় ফেয়ারহিল কনসাল্টিং লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে পাচার করেছিলেন।”

বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের যৌথ উদ্যোগে গঠিত Stolen Asset Recovery (StAR) Initiative এই মামলাকে “Rahman Returns Three Tranches” নামে আর্কাইভ করেছে। ওই রেকর্ডে বাংলাদেশের সরকার ও সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক আইনি সহায়তার মাধ্যমে সম্পদ উদ্ধারের প্রক্রিয়া বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

আরাফাত রহমান কোকোর মামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির, যেখানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, আইনি প্রমাণপত্র এবং ফেরত আনা সম্পদের সমন্বয় ঘটেছে। এটি প্রমাণ করে যে কার্যকর আন্তর্জাতিক জবাবদিহি ও আইনি প্রক্রিয়া দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টায় বাস্তব ফল দিতে পারে।

তারেক রহমান: আদালত ও আন্তর্জাতিক নজরদারিতে আইনি লড়াই
বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমান, যিনি বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও লন্ডনে অবস্থানরত, তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় রয়েছে।

আদালতের নথি অনুযায়ী, তারেক রহমান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সহযোগী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে প্রায় ২০৪ মিলিয়ন টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা দায়ের করে, যা বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত আর্থিক অপরাধ মামলায় পরিণত হয়।

দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পর, ২০১৬ সালে হাইকোর্ট তারেক রহমানের খালাসের রায় বাতিল করে তাঁকে সাত বছরের কারাদণ্ড ও ২০ কোটি টাকা জরিমানা করে। এই মামলার অন্যতম বৈশ্বিক দিক ছিল এফবিআই এজেন্ট ডেব্রা লাপ্রেভোট-এর সাক্ষ্য। তিনি বিদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন ও তহবিলের গতিপথ সম্পর্কে প্রমাণ উপস্থাপন করেন, যা মামলাটিকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার এক বিরল উদাহরণে পরিণত করে।

হাইকোর্ট রায়ে তারেক রহমানের কর্মকাণ্ডকে “আর্থিক অপরাধ” হিসেবে অভিহিত করে উল্লেখ করে:
দুদকের আইনজীবী রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “আদালত স্পষ্ট করেছে যে ক্ষমতা ও অর্থ পাচার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, এবং সময় এসেছে এসব অপরাধের প্রতি শূন্য সহনশীলতা প্রদর্শনের।” এই মামলা কেবল ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার প্রশ্নই তোলেনি; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও জবাবদিহির সীমারেখা নিয়েও এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত করেছে।

ইউনূস সরকারের শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ: প্রমাণে দুর্বলতা
২০২৪ সালের আগস্টে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে একাধিক তদন্ত শুরু করে। অভিযোগের মূল বিষয় ছিল — অবৈধ সম্পদ অর্জন, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিদেশে সম্পদ লুকানোর সম্ভাবনা।

তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা লক্ষ্য করেছেন, এই অভিযোগগুলো এখন পর্যন্ত যাচাইযোগ্য কোনো প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত নয়। বিদেশি আদালতের রায়, সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণের নথি, কিংবা আন্তর্জাতিক আইনি সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ এসবের কোনো উদাহরণ ইউনূস সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়নি।

রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান এবং আল জাজিরাসহ একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ইউনূস প্রশাসনের এই তদন্ত কার্যক্রমকে “রাজনৈতিকভাবে প্রণোদিত দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান” হিসেবে বর্ণনা করেছে। তারা উল্লেখ করেছে যে, বিদেশি কোনো সংস্থা এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা বা তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে সম্পদ-সংক্রান্ত কোনো সক্রিয় মামলা বা আইনি পদক্ষেপের নিশ্চয়তা দেয়নি।

এর বিপরীতে, তারেক রহমান ও তার ভাইয়ের অর্থ পাচারের মামলায় রয়েছে মার্কিন বিচার বিভাগের ফাইলিং, সিঙ্গাপুর আদালতের বাজেয়াপ্তকরণ আদেশ এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ডকুমেন্টস। অন্যদিকে, শেখ হাসিনাকে ঘিরে বর্তমান অভিযোগগুলো এখনো প্রেস বিবৃতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বক্তব্যের সীমারেখা অতিক্রম করতে পারেনি।

বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন
সাবেক দুদক তদন্তকারী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আরাফাত কোকোর মামলাটি দেখিয়েছে একটি বিশ্বাসযোগ্য সম্পদ উদ্ধারের জন্য কী প্রয়োজন।

বিশ্বব্যাংকের Stolen Asset Recovery (StAR) Initiative-এর এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) বলেছেন, “আরাফাত রহমানের মামলা হলো বাংলাদেশের সাপেক্ষে সর্বাধিক সফল বিদেশে পাঠানো সম্পদ উদ্ধারের উদাহরণ।” তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মন্তব্য করছেন, ইউনূস সরকারের পদ্ধতি প্রদর্শন করছে “প্রথমে অভিযোগ, পরে প্রমাণ”-এর রাজনীতি।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ড. শফিক রেজা বলেন, “ইউনুস প্রশাসনের কাছে যদি সত্যিই শেখ হাসিনার পরিবারের বিরুদ্ধে প্রমাণ থাকত, তাহলে এতদিনে বিদেশি ফাইলিং দেখতাম। সম্পদ উদ্ধার কাগজের প্রমাণও এখন পর্যন্ত নেই।”

নথির গুরুত্ব
দুর্নীতি-বিরোধী বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে নথির ওপর, ঘোষণার ওপর নয়। একটি বিদেশি বাজেয়াপ্তকরণ আদেশ, সিভিল ফাইলিং বা পারস্পরিক আইনি সহায়তার নথি আইনি ও প্রমাণসমৃদ্ধ। এটি কোনো রাজনৈতিক বিবৃতি দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায় না।

এই মানদণ্ডে, তারেক ও তার ভাইয়ের মামলাগুলোই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির মধ্যে একমাত্র আন্তর্জাতিকভাবে যাচাইযোগ্য নথিসমৃদ্ধ মামলা। শেখ হাসিনার পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগে নথির অনুপস্থিতি নির্দোষিতা প্রমাণ করে না, কিন্তু এটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে নির্বাচনী বা রাজনৈতিকভাবে উদ্দীপ্ত অভিযোগগুলো আইনি ভিত্তি থেকে বঞ্চিত হতে পারে।

কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
বাংলাদেশের দুর্নীতি-বিরোধী মামলার বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে সঙ্গতির ওপর। যেমন আরাফাত ও তারেক রহমানের বিদেশে নথিভুক্ত ও প্রমাণিত। আবার শেখ হাসিনা ও তআর পরিবারের মামলা কেবল অভিযোগের ওপর নির্ভরশীল। তখন স্পষ্ট বোঝা যায়, বিচার প্রক্রিয়া নির্বাচনী বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, ব্যবস্থাগত সংস্কার দ্বারা নয়। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, যাচাইযোগ্য কাগজপত্র ছাড়া, সরকারের দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান স্মরণীয় হবে সংস্কার হিসেবে নয়, প্রতিশোধ হিসেবে।

গত দুই দশকে বাংলাদেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্ত দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছে। বেগম খালেদা জিয়ার দুই পুত্র— তারেক রহমান ও আরাফাত “কোকো” রহমান আন্তর্জাতিকভাবে নথিভুক্ত অর্থ পাচার মামলার মুখোমুখি হয়েছেন। এসব মামলার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আদালতের নথি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের ফাইলিং এবং সিঙ্গাপুরে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ, যা তাদের অবৈধ আর্থিক লেনদেনের একটি স্পষ্ট প্রমাণপত্র সরবরাহ করেছে।

এই নথিগুলো একাধিক বিদেশি সংস্থার সহযোগিতায় করা হয়েছে। তারা বাংলাদেশের জন্য সম্পদ পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে, ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুললেও, এখন পর্যন্ত তেমন কোনো তুলনীয় প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি।

ফলস্বরূপ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জবাবদিহির প্রশ্নে দেখা যাচ্ছে এক বৈপরীত্যপূর্ণ বাস্তবতা যেখানে অভিযোগ অনেক, কিন্তু প্রমাণ ও ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে পার্থক্য স্পষ্ট।

আরাফাত “কোকো” রহমান: বিদেশি নথিপত্রে প্রমাণিত অর্থ পাচারের মামলা
বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো বাংলাদেশের সবচেয়ে নথিভুক্ত ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অর্থ পাচার মামলার অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের নথি অনুযায়ী, কোকোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় ৩০ লাখ মার্কিন ডলার সিঙ্গাপুরের একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাওয়া যায়। এই অর্থের উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত সিমেন্স বাংলাদেশ কর্তৃক প্রদত্ত ঘুষের অর্থ।

বিচার বিভাগের ২০১২ সালের অভিযোগপত্রে বলা হয়, “বিচার বিভাগ সিঙ্গাপুরে কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে সিভিল বাজেয়াপ্তকরণ মামলা দায়ের করে, যেখানে আনুমানিক ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জমা ছিল। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, এই অর্থগুলো সিমেন্স বাংলাদেশ কর্তৃক আরাফাত ‘কোকো’ রহমানকে প্রদত্ত ঘুষের ফল।”

এই মামলার ফলস্বরূপ, সিঙ্গাপুরের আদালত প্রায় ৮০০ মিলিয়ন টাকা (প্রায় ৯.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বাংলাদেশে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয়। দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর ২৮ আগস্ট ২০১৩ সালের প্রতিবেদনে এই রায় নিশ্চিত করে বলা হয়: “সিঙ্গাপুরের একটি আদালত… দেশের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে ৮০০ মিলিয়ন টাকা ফেরত দিতে নির্দেশ দিয়েছে… যা কোকো ২০০১–২০০৬ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় ফেয়ারহিল কনসাল্টিং লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে পাচার করেছিলেন।”

বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের যৌথ উদ্যোগে গঠিত Stolen Asset Recovery (StAR) Initiative এই মামলাকে “Rahman Returns Three Tranches” নামে আর্কাইভ করেছে। ওই রেকর্ডে বাংলাদেশের সরকার ও সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক আইনি সহায়তার মাধ্যমে সম্পদ উদ্ধারের প্রক্রিয়া বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

আরাফাত রহমান কোকোর মামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির, যেখানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, আইনি প্রমাণপত্র এবং ফেরত আনা সম্পদের সমন্বয় ঘটেছে। এটি প্রমাণ করে যে কার্যকর আন্তর্জাতিক জবাবদিহি ও আইনি প্রক্রিয়া দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টায় বাস্তব ফল দিতে পারে।

তারেক রহমান: আদালত ও আন্তর্জাতিক নজরদারিতে আইনি লড়াই
বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমান, যিনি বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও লন্ডনে অবস্থানরত, তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় রয়েছে।

আদালতের নথি অনুযায়ী, তারেক রহমান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সহযোগী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে প্রায় ২০৪ মিলিয়ন টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা দায়ের করে, যা বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত আর্থিক অপরাধ মামলায় পরিণত হয়।

দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পর, ২০১৬ সালে হাইকোর্ট তারেক রহমানের খালাসের রায় বাতিল করে তাঁকে সাত বছরের কারাদণ্ড ও ২০ কোটি টাকা জরিমানা করে। এই মামলার অন্যতম বৈশ্বিক দিক ছিল এফবিআই এজেন্ট ডেব্রা লাপ্রেভোট-এর সাক্ষ্য। তিনি বিদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন ও তহবিলের গতিপথ সম্পর্কে প্রমাণ উপস্থাপন করেন, যা মামলাটিকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার এক বিরল উদাহরণে পরিণত করে।

হাইকোর্ট রায়ে তারেক রহমানের কর্মকাণ্ডকে “আর্থিক অপরাধ” হিসেবে অভিহিত করে উল্লেখ করে:
দুদকের আইনজীবী রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “আদালত স্পষ্ট করেছে যে ক্ষমতা ও অর্থ পাচার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, এবং সময় এসেছে এসব অপরাধের প্রতি শূন্য সহনশীলতা প্রদর্শনের।” এই মামলা কেবল ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার প্রশ্নই তোলেনি; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও জবাবদিহির সীমারেখা নিয়েও এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত করেছে।

ইউনূস সরকারের শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ: প্রমাণে দুর্বলতা
২০২৪ সালের আগস্টে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে একাধিক তদন্ত শুরু করে। অভিযোগের মূল বিষয় ছিল — অবৈধ সম্পদ অর্জন, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিদেশে সম্পদ লুকানোর সম্ভাবনা।

তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা লক্ষ্য করেছেন, এই অভিযোগগুলো এখন পর্যন্ত যাচাইযোগ্য কোনো প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত নয়। বিদেশি আদালতের রায়, সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণের নথি, কিংবা আন্তর্জাতিক আইনি সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ এসবের কোনো উদাহরণ ইউনূস সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়নি।

রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান এবং আল জাজিরাসহ একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ইউনূস প্রশাসনের এই তদন্ত কার্যক্রমকে “রাজনৈতিকভাবে প্রণোদিত দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান” হিসেবে বর্ণনা করেছে। তারা উল্লেখ করেছে যে, বিদেশি কোনো সংস্থা এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা বা তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে সম্পদ-সংক্রান্ত কোনো সক্রিয় মামলা বা আইনি পদক্ষেপের নিশ্চয়তা দেয়নি।

এর বিপরীতে, তারেক রহমান ও তার ভাইয়ের অর্থ পাচারের মামলায় রয়েছে মার্কিন বিচার বিভাগের ফাইলিং, সিঙ্গাপুর আদালতের বাজেয়াপ্তকরণ আদেশ এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ডকুমেন্টস। অন্যদিকে, শেখ হাসিনাকে ঘিরে বর্তমান অভিযোগগুলো এখনো প্রেস বিবৃতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বক্তব্যের সীমারেখা অতিক্রম করতে পারেনি।

বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন
সাবেক দুদক তদন্তকারী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আরাফাত কোকোর মামলাটি দেখিয়েছে একটি বিশ্বাসযোগ্য সম্পদ উদ্ধারের জন্য কী প্রয়োজন।

বিশ্বব্যাংকের Stolen Asset Recovery (StAR) Initiative-এর এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) বলেছেন, “আরাফাত রহমানের মামলা হলো বাংলাদেশের সাপেক্ষে সর্বাধিক সফল বিদেশে পাঠানো সম্পদ উদ্ধারের উদাহরণ।” তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মন্তব্য করছেন, ইউনূস সরকারের পদ্ধতি প্রদর্শন করছে “প্রথমে অভিযোগ, পরে প্রমাণ”-এর রাজনীতি।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ড. শফিক রেজা বলেন, “ইউনুস প্রশাসনের কাছে যদি সত্যিই শেখ হাসিনার পরিবারের বিরুদ্ধে প্রমাণ থাকত, তাহলে এতদিনে বিদেশি ফাইলিং দেখতাম। সম্পদ উদ্ধার কাগজের প্রমাণও এখন পর্যন্ত নেই।”

নথির গুরুত্ব
দুর্নীতি-বিরোধী বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে নথির ওপর, ঘোষণার ওপর নয়। একটি বিদেশি বাজেয়াপ্তকরণ আদেশ, সিভিল ফাইলিং বা পারস্পরিক আইনি সহায়তার নথি আইনি ও প্রমাণসমৃদ্ধ। এটি কোনো রাজনৈতিক বিবৃতি দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায় না।

এই মানদণ্ডে, তারেক ও তার ভাইয়ের মামলাগুলোই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির মধ্যে একমাত্র আন্তর্জাতিকভাবে যাচাইযোগ্য নথিসমৃদ্ধ মামলা। শেখ হাসিনার পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগে নথির অনুপস্থিতি নির্দোষিতা প্রমাণ করে না, কিন্তু এটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে নির্বাচনী বা রাজনৈতিকভাবে উদ্দীপ্ত অভিযোগগুলো আইনি ভিত্তি থেকে বঞ্চিত হতে পারে।

কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
বাংলাদেশের দুর্নীতি-বিরোধী মামলার বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে সঙ্গতির ওপর। যেমন আরাফাত ও তারেক রহমানের বিদেশে নথিভুক্ত ও প্রমাণিত। আবার শেখ হাসিনা ও তআর পরিবারের মামলা কেবল অভিযোগের ওপর নির্ভরশীল। তখন স্পষ্ট বোঝা যায়, বিচার প্রক্রিয়া নির্বাচনী বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, ব্যবস্থাগত সংস্কার দ্বারা নয়। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, যাচাইযোগ্য কাগজপত্র ছাড়া, সরকারের দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান স্মরণীয় হবে সংস্কার হিসেবে নয়, প্রতিশোধ হিসেবে।

আরো পড়ুন

সর্বশেষ