দেশের শেয়ারবাজার এখন যেন একটা ডুবন্ত জাহাজ। যেখানে একসময় মধ্যবিত্তের স্বপ্ন ছিল, সঞ্চয়ের টাকা বাড়ানোর আশা ছিল, সেখানে এখন শুধু হতাশা আর অনিশ্চয়তা। গত নয় মাসে প্রায় ৬২ হাজার বিনিয়োগকারী হয় তাদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন, নয়তো তাদের পোর্টফোলিও একদম শূন্য হয়ে গেছে। এই সংখ্যাটা শুধু একটা পরিসংখ্যান নয়, এটা আসলে লাখো পরিবারের ভাঙা আশার গল্প।
যে দেশে একটা নির্বাচিত সরকারকে অস্বাভাবিক উপায়ে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় বসেছে একটা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা, সেখানে অর্থনীতির মূল স্তম্ভগুলো যে টলমল করবে সেটাই স্বাভাবিক। ইউনুস এবং তার টিম যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তখন থেকেই বাজারে একটা অস্থিরতার আবহ তৈরি হয়েছে। আর সেই অস্থিরতার মূল্য দিচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
জুলাই মাসের দাঙ্গার সেই রক্তাক্ত দিনগুলোর পর যেভাবে দেশে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে অনেকেই আশা করেছিল হয়তো শান্ত হবে সব কিছু। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যে মানুষটা সুদ নিয়ে ব্যবসা করে বিশ্বব্যাপী পরিচিত, তার হাতে দেশের অর্থনীতি পড়লে কী হবে সেটা এখন স্পষ্ট। গ্রামীণ ব্যাংকের মাইক্রোক্রেডিট মডেলে যেভাবে গরিব মানুষের কাছ থেকে উচ্চ সুদে টাকা নেওয়া হয়, সেই মানসিকতা দিয়ে কি পুঁজিবাজারের মতো সংবেদনশীল একটা সেক্টর সামলানো যায়?
শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের এই পলায়নের পেছনে রয়েছে গভীর আস্থাহীনতা। মানুষ যখন দেখে যে যারা ক্ষমতায় আছে তাদের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন আছে, তখন তারা কীভাবে বিশ্বাস করবে যে তাদের বিনিয়োগ নিরাপদ? সেন্ট্রাল ডিপোজিটরির তথ্য বলছে, বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১৬ লাখ ৮২ হাজার থেকে নেমে এসেছে ১৬ লাখ ৩২ হাজারে। এর সাথে যোগ করুন আরও ৩২ হাজার শেয়ারশূন্য অ্যাকাউন্ট। এই সংখ্যাগুলো আসলে বলছে যে মানুষ আর আস্থা রাখতে পারছে না।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো বিদেশি বিনিয়োগও কমছে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, বেক্সিমকো ফার্মা, রেনেটার মতো বড় কম্পানিগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়া মানে আন্তর্জাতিক বাজারও বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সংশয়ে আছে। যখন জুলাইয়ের ঘটনাবলীর পেছনে বিদেশি অর্থায়নের কথা শোনা যায়, তখন এটা পরিষ্কার যে যারা এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে তারা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় আগ্রহী নয়। তারা চায় অস্থিরতা, যাতে তাদের স্বার্থ হাসিল হয়।
ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমনের কথাগুলো আসলে খুবই স্পষ্ট। কয়েকজনকে শাস্তি দিলেই বাজারে আস্থা ফিরবে না। মানুষ বিনিয়োগ করে মুনাফার আশায়, লোকসানের আশায় নয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের কোনো সুস্পষ্ট নীতি নেই, কোনো রোডম্যাপ নেই। শুধু কিছু উচ্চাভিলাষী ঘোষণা আর বাস্তবতাবিহীন প্রতিশ্রুতি। ব্রোকার হাউসগুলো এখন টিকে থাকার সংগ্রাম করছে, কর্মী ছাঁটাই করছে। এটা শুধু শেয়ারবাজারের সমস্যা নয়, এটা পুরো অর্থনীতির একটা লক্ষণ।
সামরিক বাহিনীর সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা একটা সরকারের কাছ থেকে বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সঠিক নীতি আশা করাটাই হয়তো বাড়াবাড়ি। সেনাবাহিনীর কাজ হলো দেশ রক্ষা করা, অর্থনীতি চালানো নয়। আর যখন তারা রাজনৈতিক ভূমিকায় নেমে আসে, তখন স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। শেয়ারবাজারের এই অবস্থা তারই একটা প্রমাণ।
ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সহায়তায় দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে যারা ক্ষমতায় এসেছে, তাদের কাছে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অগ্রাধিকার নয়। তাদের অগ্রাধিকার হলো ক্ষমতায় টিকে থাকা, যে কোনো উপায়ে। আর এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যে মানুষ তাদের সঞ্চয়ের টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিল সন্তানের পড়াশোনার খরচ জোগাড়ের জন্য, বাড়ি করার স্বপ্ন দেখে, তারা এখন দেখছে তাদের টাকা দিনদিন কমে যাচ্ছে।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারছে না। কারণ তারাও জানে না তাদের উপর কার নির্দেশ, কার কথা শুনতে হবে। একটা অবৈধ সরকারের অধীনে কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থাই ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। কারণ বৈধতার সংকট সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। যখন সরকারের নিজের বৈধতা নেই, তখন তার করা যে কোনো সিদ্ধান্তই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
শেয়ারবাজারের এই পতন আসলে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের একটা প্রতিফলন মাত্র। যখন একটা দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে জোর করে থামিয়ে দেওয়া হয়, যখন নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দিয়ে একটা অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকে না। বিনিয়োগকারীরা, দেশি হোক বা বিদেশি, তারা চায় স্থিতিশীলতা, পূর্বাভাসযোগ্যতা। কিন্তু ইউনুস সরকারের অধীনে এই দুটোর কোনোটাই নেই।
এখন প্রশ্ন হলো, এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে? যতদিন এই অবৈধ ব্যবস্থা ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন শেয়ারবাজারসহ অর্থনীতির সব সেক্টরেই এই অনিশ্চয়তা থাকবে। মানুষ তাদের টাকা তুলে নিয়ে যাবে, বিদেশি বিনিয়োগ কমবে, কোম্পানিগুলো মূলধন যোগাড় করতে পারবে না। আর এর ফল ভোগ করবে সাধারণ মানুষ, যাদের চাকরি যাবে, যাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, যাদের স্বপ্ন ভেঙে যাবে। ইউনুস আর তার দল হয়তো তাদের বৈদেশিক প্রভুদের খুশি রাখতে পারবে, কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের কাছে তারা শুধুই ব্যর্থতার আরেকটা উদাহরণ হয়ে থাকবে।

