১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের—শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী ও গবেষকদের—পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। এটি কোনো যুদ্ধকালীন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাহীন, নেতৃত্বশূন্য ও চিরকাল দুর্বল করে রাখার একটি ঠাণ্ডা মাথার গণহত্যা। এই নৃশংস পরিকল্পনার মূল নির্দেশদাতা ছিল পাকিস্তানি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, আর বাস্তবায়নের খুনি হাতিয়ার ছিল জামাতে ইসলামের আদর্শিক ক্যাডারদের গড়ে তোলা আল-বদর বাহিনী।
রাও ফরমান আলীর ডায়েরি: হত্যার নীলনকশা
স্বাধীনতার পর গভর্নর হাউসের ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার হওয়া রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে পাওয়া যায় বুদ্ধিজীবীদের নাম-ঠিকানার তালিকা। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নামের পাশে টিক চিহ্ন দেওয়া ছিল, যাদের অধিকাংশই ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি সাংবাদিক আলতাফ গওহরের সাক্ষ্য অনুসারে, ফরমান আলী নিজেই এই তালিকা থেকে নাম কেটে দিতেন—যেমন সানাউল হকের নাম কেটে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। এই ডায়েরি প্রমাণ করে যে, বুদ্ধিজীবী নিধন ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের পরিকল্পিত অপারেশন। ফরমান আলী পরবর্তীতে এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও, তার ডায়েরি ও সমসাময়িক সাক্ষ্যপ্রমাণ তার দায় এড়াতে পারেনি।
আল-বদর বাহিনী: জামাতে ইসলামের খুনি যন্ত্র
জামাতে ইসলামের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ থেকে গড়ে ওঠা আল-বদর বাহিনী ছিল এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান নির্বাহী। জামাতের মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’-এর ১৯৭১ সালের প্রতিবেদনেই উল্লেখ আছে যে, আল-বদর গঠিত হয় ছাত্রসংঘের নেতৃত্বে। আল-বদরের প্রধান অপারেশন ইন-চার্জ চৌধুরী মইনুদ্দিন ও চিফ এক্সিকিউটর আশরাফুজ্জামান খান—দুজনেই জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা। তাদের ডায়েরিতে পাওয়া যায় হত্যার তালিকা ও ঠিকানা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, জামাতে ইসলাম আল-বদরকে সক্রিয় সমর্থন দিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যায় ‘দোষী ভূমিকা’ পালন করেছে। মতিউর রহমান নিজামী (আল-বদরের প্রধান), আলী আহসান মোহাম্মদ মোজাহিদ, চৌধুরী মইনুদ্দিন, আশরাফুজ্জামান খানসহ জামাতের একাধিক নেতা এই অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। নিজামীকে ২০১৬ সালে ফাঁসি দেওয়া হয় বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে।
উদ্দেশ্য একটি জাতিকে মেধাহীন করা
যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে—যখন পাকিস্তানি পরাজয় নিশ্চিত—১৪ ডিসেম্বর রাতে ঢাকায় ২০০-এর বেশি বুদ্ধিজীবীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। চোখ বেঁধে, নির্যাতন করে রায়েরবাজার, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের কসাইখানায় হত্যা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট: স্বাধীন বাংলাদেশকে তার সেরা মস্তিষ্ক থেকে বঞ্চিত করা। এটি ছিল জাতির ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ডোবানোর চক্রান্ত।
জামাতের অস্বীকার: ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা
আজও জামাতে ইসলাম এই দায় অস্বীকার করে। সাম্প্রতিক বক্তব্যে তাদের নেতারা দাবি করছেন যে, বুদ্ধিজীবী হত্যা ‘ভারতীয় ষড়যন্ত্র’ বা ‘অযৌক্তিক’। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের রায়, ডায়েরির প্রমাণ, সাক্ষ্য ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এই অস্বীকারকে মিথ্যা প্রমাণ করে। জামাতের এই বয়ান শুধু ইতিহাসকে অস্পষ্ট করে না, বরং শহীদদের স্মৃতিকে অপমান করে।
এই গণহত্যা বাংলাদেশের ইতিহাসের কালো দাগ। জামাতে ইসলামের এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। জাতি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব এই সত্যকে সংরক্ষণ করা, যাতে কোনোদিনও পরাজিত শক্তি মাথা তুলতে না পারে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না।

