বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি ও দিকনির্দেশনা। কিন্তু জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের রাজনৈতিক অবস্থান ও বক্তব্য ক্রমশ এই চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠছে। তার রাজনীতিতে পরাজিত পাকিস্তানপন্থার প্রতি নীরব সহনশীলতা, মুক্তিযুদ্ধের মিত্র ভারতের প্রতি অতিরঞ্জিত বিরোধিতা এবং চীনের দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা স্পষ্ট। এই সংযোজন না শুধু ঐতিহাসিক সত্যকে বিকৃত করছে, বরং রাষ্ট্রের স্বার্থকেই বিপন্ন করছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে ‘১৯৭১-এর ইস্যু সমাধানের’ আহ্বান: ইতিহাসের অস্বীকার
নাহিদ ইসলাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা থাকাকালীন পাকিস্তানি হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে বলেছিলেন যে, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগ ‘ইতিহাসের শেষ অধ্যায়’ মনে করলেও তারা এটাকে ‘ইতিহাসের ধারাবাহিকতা’ হিসেবে দেখেন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে এই ‘ইস্যু’ সমাধান করতে চান। এই বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনকে ‘ইস্যু’তে পরিণত করে ঐতিহাসিক অপরাধকে আপেক্ষিক করে তোলে। যেখানে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি ও রাজাকারদের বিচারের দাবি জাতির চিরন্তন প্রত্যাশা, সেখানে এ ধরনের ‘সমাধানের’ কথা বলা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের পথ খুলে দেয়।
এছাড়া, তার দলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতি (ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের অনুপস্থিতিতে) এবং জামায়াতে ইসলামী নেতাদের আমন্ত্রণ এই সন্দেহকে আরও গভীর করে। যদিও তিনি ‘প্রো-পাকিস্তান’ রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন বলে দাবি করেন, তার বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তির প্রতি কোমলতা স্পষ্ট।
ভারতবিরোধিতা: ঐতিহাসিক মিত্রতাকে খাটো করা
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সামরিক, কূটনৈতিক ও মানবিক সহায়তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু নাহিদ ইসলামের বয়ানে ভারতের প্রতি ধারাবাহিক বিরোধিতা দেখা যায়। তিনি ভারতকে ‘হেজেমনিক’ ও ‘ডমিনেটিং’ বলে অভিহিত করেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে ‘অতিরিক্ত নির্ভরতা’ বলে সমালোচনা করেন এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগকে ‘মিথ্যা প্রোপাগান্ডা’ বলে উড়িয়ে দেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি আওয়ামী লীগ ও ভারতকে বিপ্লবী নেতাদের ওপর হামলার জন্য দায়ী করেছেন। এই অতিরঞ্জিত বিরোধিতা শুধু ঐতিহাসিক সত্যকে বিকৃত করে না, বরং আঞ্চলিক ভারসাম্যকেও বিঘ্নিত করে।
যদিও তিনি ‘প্রো-ইন্ডিয়া’ রাজনীতিরও বিরোধিতা করেন এবং ‘বাংলাদেশ-কেন্দ্রিক’ নীতির কথা বলেন, তার বক্তব্যে ভারতের প্রতি একপাক্ষিক নেতিবাচকতা প্রকাশ পায়। এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্যুতি, কারণ ১৯৭১-এ ভারতের সহায়তা ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন কঠিন হতো।
চীনমুখিতা ও আঞ্চলিক ভারসাম্যের অভাব
নাহিদ ইসলামের রাজনীতিতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে, যদিও সরাসরি ‘প্রো-চায়না’ বলে প্রমাণিত নয়। তার দলের নীতিতে স্বনির্ভর অর্থনীতি ও বিদেশি প্রভাবমুক্ত রাজনীতির কথা বলা হলেও, ভারতবিরোধী সুর এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ‘সমাধানের’ আহ্বান চীনের আঞ্চলিক প্রভাব বাড়ানোর পথ সুগম করতে পারে। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে সকল প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রয়োজন, কিন্তু নাহিদের বয়ানে এই সূক্ষ্ম হিসাব অনুপস্থিত।
রাষ্ট্রকে দুর্বল করার ঝুঁকি
নাহিদ ইসলামের এই রাজনৈতিক সংযোজন—পাকিস্তানের সঙ্গে ঐতিহাসিক অপরাধকে ‘সমাধানযোগ্য ইস্যুতে পরিণত করা, ভারতের প্রতি অতিরঞ্জিত বিরোধিতা এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির প্রতি নীরবতা—মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দুর্বল করে। এটি সুবিধাবাদী কূটনীতিকে আদর্শের জায়গায় বসিয়ে রাষ্ট্রকে বিভক্ত ও দুর্বল করতে পারে। বাংলাদেশের জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে রাজনীতি ইতিহাসকে অস্পষ্ট না করে এবং জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।

