মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বললেই ডিবি পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে যান রাজাকার ইউনূস। এটাই এখন বাস্তবতা। যদিও দেশবিরোধীদের কাছে, এটি নাকি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পথ। রোববার সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আনিস আলমগীর গণমাধ্যমকে জানান, ‘ধানমন্ডি এলাকার একটি জিম (ব্যায়ামাগার) থেকে আমাকে নিয়ে আসা হয়। ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের প্রধান আমার সঙ্গে কথা বলবেন।’
তিনি আরও বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে তাঁকে ধানমন্ডি থেকে আনা হয়। আটটার দিকে তাঁরা ডিবি কার্যালয়ে পৌঁছান। তখন থেকে অপেক্ষায় রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে তখন পর্যন্ত ডিবি প্রধানের কথা হয়নি।
আওয়ামী লীগের আমলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যারা প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছে তাদের মধ্যে সাংবাদিক আনিস আলমগীর অন্যতম। কিন্তু তখন তাকে এভাবে ডিবি দিয়ে তুলে নেওয়া হয়নি। তবে সম্প্রতি ইউনূস ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা করছিলেন তিনি। তার কণ্ঠরোধে সরব ছিলেন জামায়াত ও ইউনূসের বাহিনী। শেষ পর্যন্ত তাকে তুলেই নিয়ে যাওয়া হলো।
সম্প্রতি সরকার উৎখাতে ষড়যন্ত্রের মামলায় জাতীয় প্রেসক্লাব ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্সের সেক্রেটারি ও দৈনিক ভোরের কাগজের অনলাইন প্রধান মিজানুর রহমান সোহেলকে মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) দিবাগত রাত ১২টার দিকে আটক করে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্যরা। ডিবির পোশাক গায়ে দেয়া পাঁচ ব্যক্তি আটক করে নিয়ে যান বলে অভিযোগ করেন মিজানুর রহমান সোহেলের স্ত্রী সুমাইয়া সীমা। সারা রাত আটকে রাখার পর বুধবার (১৯ নভেম্বর) সকাল সোয়া ১০টার দিকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত আগস্টে সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি প্রায় তিন মাসের বেশি সময় জেল খেটেছেন। এছাড়া দেশের জ্যেষ্ঠ ৪ সাংবাদিক ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে বন্দি। তাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ, কিন্তু তদন্ত শেষ হয়নি। জামিন হয় না বারবার আবেদন করেও। আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংগঠন সিপিজে যখন তাদের মুক্তির আহ্বান জানায়, তখন ইউনুসের প্রেস সচিব বলেন, “এই বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই।” আইনের শাসনের দোহাই দিয়ে দায় এড়ানো হয় সহজেই।
কিন্তু এই একই ব্যক্তি কি ২০২৪ সালের জুলাইয়ে আইনের শাসনের কথা ভেবেছিলেন? যখন রাজপথে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হলো, তখন কোন আইন মেনে ক্ষমতায় এলেন তিনি? সংবিধান কি এভাবে ক্ষমতা দখলের অনুমতি দেয়? জনগণের ভোট ছাড়া যিনি দেশ চালাচ্ছেন, তিনিই আজ আইনের দোহাই দিচ্ছেন।
শাকিল আহমেদ, ফারজানা রুপা, মোজাম্মেল বাবু আর শ্যামল দত্ত। এই চারজন সাংবাদিক। তাদের অপরাধ কী? সরকারের পক্ষে লিখেছেন, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেননি। এটা কি অপরাধ? যদি তাই হয়, তাহলে নতুন আইন করে তাদের বিচার হোক। কিন্তু হত্যা মামলা? যে হত্যার সাথে তাদের দূরতম সম্পর্কও নেই, সেই মামলায় তারা মাসের পর মাস কারাগারে পড়ে আছেন।
বাংলাদেশে এখন সত্য বলা এক সাহসী এবং একইসঙ্গে বিপজ্জনক কাজ। সাংবাদিক, লেখক ও মানবাধিকারকর্মীদের হয়রানি, বেআইনি গ্রেপ্তার এবং গুম নজিরবিহীন মাত্রায় পৌঁছেছে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন, আর দায়িত্ব পালনের সময় প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন। অসংখ্য গণমাধ্যমকর্মী প্রতিনিয়ত হুমকি, আদালতের সমন ও ভয়ভীতির মুখে পড়ছেন। এতে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যেখানে সত্য উচ্চারণ করলে হতে পারে মৃত্যু।
এক বছরে ৪৯৬ সাংবাদিক হয়রানির শিকার
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দমন-পীড়ন আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। সাংবাদিক ও লেখকদের জোরপূর্বক আদালতে টেনে নেওয়া হয় মনগড়া হত্যা ও হামলার মামলায়, যেসব ঘটনার সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতাই ছিল না। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের অসংখ্য জেলায় অভিজ্ঞ ও স্থানীয় প্রতিবেদকদের গায়েবি মামলায় জড়ানো হয়। এগুলোর অধিকাংশই অতীতের রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এসব মামলায় প্রায়ই দুর্বল বা পরস্পরবিরোধী ‘সাক্ষ্য’ ব্যবহার করা হয়েছে। এর থেকে প্রমাণিত হয়ে যে, এটি ছিল স্বাধীন চিন্তাকে অপরাধে পরিণত করা এবং গণমাধ্যমকে ভয় দেখানোর এক সংগঠিত প্রচেষ্টা।
দমন শুধু আদালত পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না। শত শত সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়, আর গণমাধ্যম অফিসগুলোতে হামলা চালানো হয় ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে। সম্পাদক ও সংবাদপ্রধানদের অপসারণ করা হয়, অন্তত ১৫০ জন সংবাদকর্মী চাকরি হারান। এতে সাংবাদিক সমাজের বড় একটি অংশ হয়ে পড়ে অসহায় ও স্তব্ধ। এমনকি সরকারি তথ্য পাওয়ার নিয়মিত পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারও তথ্য অধিকার আইনের সংস্কারে প্রকাশ্য উদাসীনতা দেখিয়ে জনগণের মৌলিক জানার অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করেছে।

