নির্বাচন কমিশন আগামী রোববার এনআইডি সংশোধনের ফি বাবদ প্রায় সাড়ে বারো গুণ বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদনের উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমানে যেখানে একজন সাধারণ নাগরিককে তার জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সংশোধনে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা খরচ করতে হয়, সেখানে নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী তাকে গুনতে হবে পাঁচ হাজার টাকা। এর সঙ্গে যোগ হবে আরও ১৫ শতাংশ ভ্যাট। অর্থাৎ একটি সংশোধনে খরচ দাঁড়াবে পাঁচ হাজার সাতশ পঁচাত্তর টাকা। মাত্র কয়েক মাস আগে যে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার আর জনকল্যাণের স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, তাদের এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের চেয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার ভরাটকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, কোন যুক্তিতে এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি? নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তারা পর্যন্ত আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে এই সিদ্ধান্ত জনগণকে আরও বিপাকে ফেলবে। প্রতি মাসে প্রায় আশি হাজার মানুষ এনআইডি সংশোধনের আবেদন করেন। তাদের মধ্যে অনেকেই গরিব, নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য, যাদের জন্য পাঁচ হাজার টাকা মোটেই সামান্য অঙ্কের টাকা নয়। কিন্তু এই বাস্তবতার প্রতি কোনো সহমর্মিতা দেখা যাচ্ছে না সরকারের পলিসি মেকারদের মধ্যে।
এনআইডি কার্ড একজন নাগরিকের মৌলিক পরিচয়পত্র। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে চাকরির আবেদন, পাসপোর্ট করা, সিম কার্ড নেওয়া, ভূমি রেজিস্ট্রেশন, এমনকি করোনার টিকা নেওয়ার মতো প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি সেবায় এই কার্ড অপরিহার্য। আর এই কার্ডে যদি কোনো তথ্যগত ভুল থাকে, তাহলে একজন নাগরিক কার্যত রাষ্ট্রের কাছে অদৃশ্য হয়ে যান। তার সেবা পাওয়ার অধিকার থমকে যায়। এই প্রেক্ষাপটে সংশোধন ফি বাড়ানোর অর্থ হলো একজন নাগরিকের মৌলিক নথিতে প্রবেশাধিকারকেই ব্যয়বহুল করে তোলা।
আরও উদ্বেগজনক দিক হলো, প্রস্তাবিত নিয়মে একবার সংশোধন করার পর যদি কোনো ভুল থাকে বা পুনরায় সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তাহলে প্রতিবার গুণিতক হারে ফি বাড়বে। অর্থাৎ প্রথমবার পাঁচ হাজার, দ্বিতীয়বার দশ হাজার, তৃতীয়বার পনেরো হাজার টাকা। এই ব্যবস্থা এতটাই অযৌক্তিক যে যারা সত্যিকারের তথ্যগত সংকটে ভুগছেন, তাদের জন্য সংশোধন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। যেন নাগরিকদের শাস্তি দেওয়ার একটি নতুন পদ্ধতি খুঁজে বের করা হয়েছে।
ইউনুস সরকারের এই পদক্ষেপ শুধু জনবিরোধী নয়, এটি মূলত একটি শ্রেণিবৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত। ধনী মানুষদের জন্য পাঁচ হাজার টাকা হয়তো খুব বড় ব্যাপার নয়, কিন্তু একজন রিকশাচালক, দিনমজুর, ছোট ব্যবসায়ী বা প্রান্তিক চাষির জন্য এই টাকা প্রায় একমাসের খাবার খরচের সমান। ফলে এই নিয়মের শিকার হবেন মূলত দরিদ্র আর মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তারা হয়তো ভুল তথ্য নিয়েই কোনোমতে চলতে বাধ্য হবেন, কিংবা দালাল আর দুর্নীতিবাজদের কাছে আরও বেশি টাকা খরচ করে অবৈধ পথে সংশোধন করাতে বাধ্য হবেন।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় এনআইডি সংশোধনে ইতিমধ্যে জটিলতা আর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে প্রচুর। সঠিক সময়ে আবেদন নিষ্পত্তি না করে মানুষকে হয়রানি করা, টাকা দাবি করা, দালালদের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা, এসব অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। এই দুর্নীতি দূর করার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার অর্থ হলো, সরকার সমস্যার সমাধান করতে আগ্রহী নয়, বরং সমস্যা থেকে আয় করতে চায়। এটি এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক লুটপাট ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রস্তাবিত প্রবিধানমালায় জন্মতারিখ সংশোধনের ক্ষমতা মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ঢাকায় জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালকের কাছে কেন্দ্রীভূত করা হচ্ছে। এর মানে হলো, যদি কোনো নাগরিকের জন্মতারিখ ভুল থাকে, তাহলে তাকে তার গ্রাম থেকে অথবা জেলা শহর থেকে ঢাকায় এসে নির্বাচন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে হবে। এই সিদ্ধান্ত কতটা জনবিরোধী, তা বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার দরকার নেই। একজন সিলেট বা চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে ঢাকায় এসে সংশোধনের জন্য আবেদন করতে হলে তার যাতায়াত খরচ, থাকা-খাওয়ার খরচ, কাজ থেকে ছুটি নেওয়ার ক্ষতি, সব মিলিয়ে কত টাকা খরচ হবে? এবং সেই খরচের বোঝা বইবে কারা? সাধারণ মানুষ।
আরও হাস্যকর হলো, জন্মতারিখ সংশোধনের ক্ষমতা শুধুমাত্র একজন মহাপরিচালকের হাতে রাখার সিদ্ধান্ত। একজন কর্মকর্তার পক্ষে কি সম্ভব দেশজুড়ে আসা হাজার হাজার আবেদন সময়মতো নিষ্পত্তি করা? প্রতি মাসে যদি আশি হাজার মানুষ আবেদন করেন, তাদের মধ্যে কতজনের আবেদন জন্মতারিখ সংশোধন সংক্রান্ত? এই সংখ্যা নিশ্চয়ই কম নয়। তাহলে একজন কর্মকর্তার পক্ষে এই বিশাল কাজের চাপ সামলানো কীভাবে সম্ভব? ফলাফল হবে দীর্ঘ বিলম্ব, হয়রানি, এবং সেবা প্রদানে চরম ব্যর্থতা। আর এর মাশুল গুনতে হবে সাধারণ জনগণকে।
নতুন প্রবিধানমালায় অবশ্য আবেদন নিষ্পত্তির জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন ক্যাটাগরির আবেদন সাত দিন থেকে পঁয়তাল্লিশ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কাগজে-কলমে এই প্রস্তাব ভালো শোনালেও বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে সময়সীমা মানা হয় কদাচিৎ। আর যদি মানা না হয়, তাহলে জবাবদিহিতা কোথায়? সময়সীমা লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কী শাস্তি হবে? এসব বিষয়ে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা নেই প্রস্তাবিত প্রবিধানমালায়। ফলে এটি নিছক একটি লোক দেখানো পদক্ষেপ ছাড়া কিছু নয়।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে একটি সাধারণ প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে। তারা সংস্কারের নামে আসলে জনগণের ওপর বাড়তি আর্থিক বোঝা চাপাচ্ছেন। একদিকে বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখন যোগ হলো এনআইডি সংশোধনের মতো মৌলিক সেবায় বাড়তি খরচ। এসব পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হচ্ছে যে, এই সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কোনো মূল্য নেই।
ড. মুহাম্মদ ইউনুস যখন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তখন তার পরিচয় ছিল দরিদ্র মানুষের বন্ধু হিসেবে। কিন্তু ক্ষমতার চেয়ারে বসার পর তার প্রতিটি সিদ্ধান্ত প্রমাণ করছে যে সেই পরিচয় কতটা ভুয়া ছিল। দরিদ্র মানুষের বন্ধু হলে তিনি কি এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতেন যেখানে একজন নিম্নবিত্ত মানুষকে তার পরিচয়পত্র সংশোধন করতে প্রায় এক মাসের আয় খরচ করতে হবে? এটা কোনো সংস্কার নয়, এটা স্পষ্ট শোষণ।
আরও অবাক করা বিষয় হলো, নির্বাচন কমিশন নিজেই এই প্রস্তাব এনেছে, যে প্রতিষ্ঠানটির কথা ছিল জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা করা, নাগরিকদের পরিচয় নিশ্চিত করতে সহায়তা করা। কিন্তু এখন তারা জনগণকে শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এই প্রস্তাব যদি অনুমোদিত হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের যেটুকু আস্থা অবশিষ্ট আছে, সেটুকুও ধ্বংস হয়ে যাবে।

