মৌলভীবাজারে গৃহিণীরা শিমের চারা রোপণ করতে গিয়ে মাটি থেকে তুলে আনলেন গ্রেনেড। ঘটনাটা শুনতে যতটা অবাস্তব মনে হয়, বাস্তবে ঠিক ততটাই ভয়াবহ। একটা দেশ যখন এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে কৃষিকাজ করতে গিয়ে মানুষ সামরিক বিস্ফোরক খুঁজে পায়, তখন বুঝতে হবে সেই দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। আর এই ভাঙনের স্থপতি হলেন মুহাম্মদ ইউনুস এবং সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান।
জুলাই মাসের যে দাঙ্গা হলো, যেখানে তিনশোর বেশি মানুষ মারা গেল, সেটা কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলন ছিল না। ছিল একটি সুপরিকল্পিত সামরিক অভ্যুত্থান। সেই সময় রাস্তায় যে ধরনের অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল, যেভাবে সরকারি স্থাপনা জ্বালানো হয়েছিল, যেভাবে কারাগার ভেঙে দোষী সাব্যস্ত জঙ্গিদের মুক্ত করা হয়েছিল, তা বিচ্ছিন্ন কিছু উত্তেজিত তরুণের কাজ হতে পারে না। এর পেছনে ছিল সংগঠিত শক্তি, অর্থায়ন এবং অস্ত্র সরবরাহের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা।
এখন প্রশ্ন হলো, এই অস্ত্রগুলো এলো কোথা থেকে? মৌলভীবাজারে যে গ্রেনেড পাওয়া গেল, সেটা তো আকাশ থেকে পড়েনি। বাংলাদেশে সামরিক গ্রেডের অস্ত্র তৈরি হয় না। এগুলো আসে হয় আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাচালানের মাধ্যমে, নয়তো কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের সরাসরি সরবরাহে। জুলাইয়ের দাঙ্গার সময় যে পরিমাণ অস্ত্র রাস্তায় দেখা গেছে, তা এদেশে প্রবেশ করিয়েছে কে? সীমান্ত পাহারা দেয় সেনাবাহিনী এবং বিজিবি। তাহলে কি তাদের জ্ঞাতসারেই এই অস্ত্র প্রবেশ করেছে? নাকি তারা ইচ্ছাকৃতভাবে চোখ বন্ধ রেখেছিলেন?
ওয়াকার-উজ-জামান সেনাপ্রধান হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন নির্বাচিত সরকারের প্রতি অনুগত থাকার। কিন্তু জুলাই মাসে যখন রাস্তায় মানুষ মরছিল, যখন পুলিশ সদস্যদের পিটিয়ে মারা হচ্ছিল, তখন সেনাবাহিনী কোথায় ছিল? তারা কেন হস্তক্ষেপ করেনি? আসল সত্য হলো, তারা অপেক্ষা করছিলেন সরকার পড়ে যাওয়ার। আর যখন সরকার পড়ল, তখনই ওয়াকার সাহেব এগিয়ে এলেন ত্রাণকর্তা হয়ে। এটাকে বলে opportunism, বাংলায় যাকে বলা যায় সুবিধাবাদ। একজন সেনাপ্রধানের কাজ ছিল সংবিধান রক্ষা করা, নির্বাচিত সরকারকে রক্ষা করা। কিন্তু তিনি উল্টো সেই সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে শরিক হলেন।
আর মুহাম্মদ ইউনুস? এই লোকটা তার পুরো জীবনে একটা ভোটও পায়নি জনগণের কাছ থেকে কোনো ইস্যুতেই। তার নোবেল পুরস্কার তাকে দেশ চালানোর কোনো বৈধতা দেয় না। তার মাইক্রোক্রেডিট মডেল নিয়ে বিশ্বজুড়ে সমালোচনা আছে। বলা হয়, এই মডেল দরিদ্রদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেয়নি, বরং তাদের সুদের চক্রে আটকে ফেলেছে। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে মাইক্রোফাইন্যান্সের কারণে কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশেও গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার। একজন সুদখোর মহাজন এখন দেশ চালাচ্ছেন, এর চেয়ে বিদ্রূপের বিষয় আর কী হতে পারে?
জুলাই দাঙ্গার সময় কিছু ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয়তার খবর পাওয়া গেছে। হেফাজতে ইসলামের নেতারা খোলাখুলি মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা রাস্তায় নেমেছে। আর যেসব কারাগার ভাঙা হয়েছে, সেখান থেকে মুক্তি পেয়েছে অনেক দোষী সাব্যস্ত জঙ্গি। এটা কি কাকতালীয়? নাকি সুপরিকল্পিত? ইউনুস সাহেব এবং ওয়াকার সাহেব কি জানেন না যে তারা কাদের সমর্থনে ক্ষমতায় এসেছেন?
বিদেশি অর্থায়নের প্রশ্নটাও গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক বেশ কিছু এনজিও এবং সংস্থা বাংলাদেশে সক্রিয় যারা গণতন্ত্রের নামে আসলে নিজেদের দেশের স্বার্থ দেখে। আমেরিকার এনইডি (National Endowment for Democracy) এবং এরকম আরো অনেক সংস্থা বিভিন্ন দেশে রঙিন বিপ্লব ঘটিয়েছে। মিশর, লিবিয়া, ইউক্রেন, জর্জিয়া, মায়ানমার এসব জায়গায় যা ঘটেছে, বাংলাদেশে কি তার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না? যখন একটা দেশে অস্থিরতা তৈরি করতে হয়, তখন অস্ত্র এবং অর্থ দুটোই লাগে। আর দুটোই এসেছে বলে মনে হচ্ছে।
মৌলভীবাজারে যে গ্রেনেড পাওয়া গেছে, সেটা একা নয়। সারাদেশে এরকম আরো কত অস্ত্র লুকিয়ে আছে কে জানে? জুলাইয়ের পরে যে পরিমাণ অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে, সব তো উদ্ধার হয়নি। অনেক অস্ত্র এখনো লুকিয়ে আছে বিভিন্ন জায়গায়। কেন? কারণ আরেকটা দাঙ্গার জন্য হয়তো প্রস্তুতি চলছে। যারা একবার অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছে, তারা সেই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে যে কোনো কিছু করতে পারে। আর তাদের যদি অস্ত্রের মজুদ থাকে, তাহলে তো কথাই নেই।
ইউনুস এবং ওয়াকার দুজনেই জানেন যে তাদের ক্ষমতার কোনো বৈধতা নেই। তারা কোনো নির্বাচনে জিতে আসেননি। জনগণ তাদের ভোট দেয়নি। তারা এসেছেন একটা রক্তাক্ত দাঙ্গার মাধ্যমে। আর এই অভ্যুত্থানে যে পরিমাণ মানুষ মারা গেছে, তার দায় কিন্তু এই দুজনের ওপরই বর্তায়। ইউনুস সাহেব হয়তো ভাবছেন তার নোবেল পুরস্কার তাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাখবে, কিন্তু ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। ওয়াকার সাহেব ভাবছেন সামরিক শক্তি তাকে রক্ষা করবে, কিন্তু সামরিক শাসন কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
এখন বাংলাদেশ একটা অস্ত্রের গুদামে পরিণত হয়েছে। যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময় একটা গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতে পারে। মানুষ তাদের নিজেদের বাড়িতে নিরাপদ নয়। শিশুরা রাস্তায় খেলতে গিয়ে হয়তো একটা বোমা খুঁজে পাবে। এই যে অরাজকতা, এই যে বিশৃঙ্খলা, এর দায় কার? যারা অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছেন, তাদের। ইউনুস এবং ওয়াকার বাংলাদেশকে একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করছেন। আর এই ব্যর্থতার মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। মৌলভীবাজারের সেই পরিবারটি চেয়েছিল শুধু কিছু শিম চাষ করতে, কিন্তু পেল গ্রেনেড। এটাই এখন বাংলাদেশের চিত্র।

