Monday, December 1, 2025

বাউলের রক্তে লেখা ইউনুসের খিলাফত

মানিকগঞ্জে বাউলশিল্পীদের ওপর হামলার খবরটা পড়ে কেউ হয়তো ভাবছেন এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু না, এটা মোটেও বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এটা একটা পরিকল্পিত, সুসংগঠিত প্রকল্পের অংশ। যে প্রকল্পের নাম বাংলাদেশকে একটা ওহাবি খিলাফতে পরিণত করা। আর এই প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী হলো মুহাম্মদ ইউনুসের অবৈধ সরকার এবং তার পেছনের শক্তি জামায়াতে ইসলাম ও তাদের বিভিন্ন সহযোগী মৌলবাদী সংগঠন।

আবুল সরকার নামের একজন বাউলশিল্পীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে। কী করেছিলেন তিনি? গান গেয়েছিলেন। বাংলার মাটিতে হাজার বছর ধরে যে গান গাওয়া হয়ে আসছে, সেই গান। লালন শাহ, হাসন রাজা, পাগলা কানাই, দুদ্দু শাহ যে গান গেয়েছেন, সেই একই ধারার গান। কিন্তু এখন এই গান অপরাধ। কেন? কারণ ইউনুস সরকারের আমলে বাংলাদেশে এখন যাদের রাজত্ব, তারা বাউল-ফকির-সুফী কাউকেই সহ্য করতে পারে না। এরা বাংলার সংস্কৃতির শত্রু, এরা বাংলার ইতিহাসের শত্রু, এরা আসলে বাংলাদেশেরই শত্রু।

জুলাইয়ে যা ঘটেছিল, সেটাকে অনেকে গণঅভ্যুত্থান বলছেন। কিন্তু সত্য হলো এটা ছিল একটা সুপরিকল্পিত ক্যু। বিদেশি টাকা ঢালা হয়েছে, ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো মাঠে নেমেছিল পূর্ণ শক্তিতে, আর সামরিক বাহিনীর একাংশের মৌন সমর্থন ছিল। এই তিনের কম্বিনেশনে একটা নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে মুহাম্মদ ইউনুসকে। কিন্তু ইউনুস তো শুধু একটা মুখ। আসল ক্ষমতা কার হাতে? জামায়াতে ইসলাম এবং তাদের আদর্শিক মিত্র বিভিন্ন ওহাবি সংগঠনের হাতে।

এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে একের পর এক ঘটনা ঘটছে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে, হিন্দু মন্দির ভাঙা হচ্ছে, খ্রীষ্টানদের চার্চে বোমা হামলা হচ্ছে, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে আক্রমণ হচ্ছে, এখন বাউলশিল্পীদের পেটানো হচ্ছে। একটা প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে না? যারাই বাংলাদেশের উদার, সহনশীল, বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের ধারক, তাদের সবাইকে টার্গেট করা হচ্ছে। এটা কাকতালীয় নয়, এটা পরিকল্পিত। জামায়াতে ইসলাম এবং তাদের মিত্ররা জানে যে বাংলাদেশকে একটা মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে আগে এদেশের সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে ধ্বংস করতে হবে। আর সেই কাজটাই এখন চলছে পুরোদমে।

মানিকগঞ্জে যা ঘটেছে, তার বিবরণ পড়লে গা শিউরে ওঠে। একদিকে বাউলশিল্পীরা শান্তিপূর্ণভাবে জড়ো হয়েছিলেন আবুল সরকারের মুক্তির দাবিতে। অন্যদিকে তৌহিদী জনতা নামের একদল মৌলবাদী মিছিল নিয়ে এসে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাউলশিল্পীদের মারধর করা হয়, তাদের প্রাণ বাঁচাতে ডোবায় ঝাঁপ দিতে হয়। এই তৌহিদী জনতা কারা? এরা সেই একই লোক যারা জুলাইয়ে রাস্তায় নেমেছিল, যারা পুলিশ হত্যা করেছে, যারা সরকারি অফিস জ্বালিয়েছে। আর এখন ইউনুস সরকারের ছত্রছায়ায় এরা আইনের ঊর্ধ্বে।

প্রশাসন কী করলো? পুলিশ কোথায় ছিল যখন হামলা হচ্ছিল? উত্তর সহজ। পুলিশ জানতো এই হামলা হবে। প্রশাসন জানতো এই সংঘর্ষ হবে। কিন্তু তারা কিছু করেনি। কারণ ইউনুস সরকারের নির্দেশ এসেছে মৌলবাদীদের খুশি রাখার। যে সরকারের নিজের কোনো গণভিত্তি নেই, যে সরকার জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসেনি, তারা টিকে আছে শুধুমাত্র সামরিক সমর্থন আর মৌলবাদী শক্তির ওপর ভর করে। তাই জামায়াতের লোকজন যা করছে, তাদের সহযোগীরা যা করছে, সরকার চুপ। কারণ এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সরকারের ভিত্তিটাই নড়ে যাবে।

এখন প্রশ্ন হলো, জামায়াতে ইসলাম কেন এত মরিয়া বাউল-ফকিরদের নির্মূল করতে? কারণটা একদম স্পষ্ট। এই উপমহাদেশে ইসলামের যে রূপ দেখা যায়, সেটা মধ্যপ্রাচ্যের ওহাবি ইসলাম থেকে একদম আলাদা। এখানে ইসলাম এসেছে সুফী সাধকদের হাত ধরে। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী, নিজামুদ্দিন আউলিয়া, শাহজালাল, খানজাহান আলী এরা ইসলাম প্রচার করেছেন ভালোবাসা দিয়ে, সংগীত দিয়ে, মানবিকতা দিয়ে। এই সুফী ইসলামের সাথে হিন্দু-বৌদ্ধ ঐতিহ্যের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে বাংলার বাউল ধারা। এই ধারার কোনো সাম্প্রদায়িকতা নেই, কোনো কট্টরতা নেই। লালন শাহ বলেছিলেন, “সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে। লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।” এই যে উদার, মানবিক ইসলাম, এটাই জামায়াতে ইসলামের আসল শত্রু।

জামায়াত চায় বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা হোক সৌদি আরবের মতো কঠোর ওহাবি ইসলাম। যেখানে সংগীত হারাম, নাচ হারাম, শিল্পকলা হারাম, মুক্ত চিন্তা হারাম। যেখানে মানুষ রোবটের মতো শুধু একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে ঢালাই হয়ে বেরোবে। কিন্তু এই এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমে ধ্বংস করতে হবে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আর সেই ঐতিহ্যের সবচেয়ে বড় ধারক হলো বাউল, ফকির, সুফী সাধকরা। তাই এদের নিশ্চিহ্ন করা জামায়াতের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। মানিকগঞ্জে যা ঘটেছে, সেটা এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের একটা ধাপ মাত্র।

এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়। ওহাবিবাদ আসলে ইসলামের কোনো আদি রূপ নয়। এটা একটা আধুনিক রাজনৈতিক আন্দোলন যেটা শুরু হয়েছিল আঠারো শতকে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের হাত ধরে। আর এই মতবাদ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে খরচ করা হয়েছে সৌদি তেলের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশে হাজার হাজার মাদ্রাসা খোলা হয়েছে সৌদি টাকায়, যেখানে পড়ানো হচ্ছে ওহাবি মতবাদ। এই মতবাদের মূল কথা হলো অন্য সব মতামত, অন্য সব ব্যাখ্যা বাতিল। শুধুমাত্র তাদের ব্যাখ্যাই সঠিক, বাকি সবাই কাফের। এই মতবাদের ফসল হলো আল-কায়েদা, তালেবান, আইএস। আর বাংলাদেশে এই মতবাদের প্রধান বাহক জামায়াতে ইসলাম।

জামায়াতের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় এরা আসলে কারা। ১৯৭১ সালে এরা পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মিলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, গণহত্যা চালিয়েছে, বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছে। স্বাধীনতার পর এদের নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে সামরিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এরা আবার রাজনীতিতে ফিরে আসে। এরপর থেকে এরা একটাই কাজ করে আসছে। বাংলাদেশের সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক চরিত্র ধ্বংস করে এটাকে একটা ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করা। আর এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য এরা যে কোনো পথ বেছে নিতে প্রস্তুত। সন্ত্রাস, হত্যা, ক্যু যাই হোক না কেন।

জুলাইয়ের অভ্যুত্থান এই জামায়াতের জন্য একটা সোনালি সুযোগ এনে দিয়েছে। তারা এখন আর আন্ডারগ্রাউন্ডে নেই, তারা এখন প্রকাশ্যে রাস্তায়। তাদের লোকজন এখন প্রশাসনে ঢুকছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে ঢুকছে। আর তাদের মূল লক্ষ্য হলো একের পর এক বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চিহ্ন মুছে ফেলা। আজকে বাউলশিল্পী, কালকে রবীন্দ্রসংগীত, পরশু নাটক-সিনেমা। এভাবে এক এক করে সব কিছু নিষিদ্ধ করে দেওয়া হবে। আর তখন যা অবশিষ্ট থাকবে, সেটা আর বাংলাদেশ থাকবে না, সেটা হবে আফগানিস্তানের মতো আরেকটা তালেবানি রাষ্ট্র।

ইউনুস এই পুরো প্রকল্পে একটা হাতিয়ার মাত্র। তার খ্যাতি, তার আন্তর্জাতিক সংযোগ ব্যবহার করা হচ্ছে এই অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেওয়ার জন্য। কিন্তু মাঠে যারা কাজ করছে, আসল পরিকল্পনা যারা বাস্তবায়ন করছে, তারা হলো জামায়াত এবং তাদের মিত্ররা। ইউনুস হয়তো জানেন, হয়তো জানেন না, কিন্তু তার নামে যা হচ্ছে তার দায় তার। ইতিহাস তাকে মনে রাখবে সেই ব্যক্তি হিসেবে যিনি বাংলাদেশকে মৌলবাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের জন্মই হয়েছিল একটা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক শাসন আর ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এদেশের মানুষ স্বাধীনতা এনেছিল। কিন্তু এখন সেই একই শক্তি আবার মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। পার্থক্য শুধু এটুকু যে এবার তারা পাকিস্তানি পতাকা নয়, বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে এসেছে। কিন্তু তাদের আদর্শ একই, তাদের লক্ষ্য একই। বাংলাদেশকে একটা মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা।

মানিকগঞ্জের বাউলশিল্পীরা যারা ডোবায় ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন, তারা শুধু নিজেদের জন্য লড়ছেন না। তারা লড়ছেন বাংলাদেশের আত্মার জন্য, বাংলার সংস্কৃতির জন্য, এদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্যের জন্য। তারা প্রতিনিধিত্ব করছেন সেই বাংলাদেশের, যেখানে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই পাশাপাশি বাস করতে পারে, যেখানে গান-বাজনা-নাচ-শিল্প সবই স্বাভাবিক, যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে ভাবতে পারে, বলতে পারে। আর তাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে ইউনুস-জামায়াত চক্র, যারা চায় বাংলাদেশকে একটা অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিতে। এই লড়াই শুধু বাউলশিল্পীদের নয়, এটা পুরো বাংলাদেশের লড়াই। আর এই লড়াইয়ে হেরে গেলে যা হারাবে, তা আর কখনো ফিরে পাওয়া যাবে না।

মানিকগঞ্জে বাউলশিল্পীদের ওপর হামলার খবরটা পড়ে কেউ হয়তো ভাবছেন এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু না, এটা মোটেও বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এটা একটা পরিকল্পিত, সুসংগঠিত প্রকল্পের অংশ। যে প্রকল্পের নাম বাংলাদেশকে একটা ওহাবি খিলাফতে পরিণত করা। আর এই প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী হলো মুহাম্মদ ইউনুসের অবৈধ সরকার এবং তার পেছনের শক্তি জামায়াতে ইসলাম ও তাদের বিভিন্ন সহযোগী মৌলবাদী সংগঠন।

আবুল সরকার নামের একজন বাউলশিল্পীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে। কী করেছিলেন তিনি? গান গেয়েছিলেন। বাংলার মাটিতে হাজার বছর ধরে যে গান গাওয়া হয়ে আসছে, সেই গান। লালন শাহ, হাসন রাজা, পাগলা কানাই, দুদ্দু শাহ যে গান গেয়েছেন, সেই একই ধারার গান। কিন্তু এখন এই গান অপরাধ। কেন? কারণ ইউনুস সরকারের আমলে বাংলাদেশে এখন যাদের রাজত্ব, তারা বাউল-ফকির-সুফী কাউকেই সহ্য করতে পারে না। এরা বাংলার সংস্কৃতির শত্রু, এরা বাংলার ইতিহাসের শত্রু, এরা আসলে বাংলাদেশেরই শত্রু।

জুলাইয়ে যা ঘটেছিল, সেটাকে অনেকে গণঅভ্যুত্থান বলছেন। কিন্তু সত্য হলো এটা ছিল একটা সুপরিকল্পিত ক্যু। বিদেশি টাকা ঢালা হয়েছে, ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো মাঠে নেমেছিল পূর্ণ শক্তিতে, আর সামরিক বাহিনীর একাংশের মৌন সমর্থন ছিল। এই তিনের কম্বিনেশনে একটা নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে মুহাম্মদ ইউনুসকে। কিন্তু ইউনুস তো শুধু একটা মুখ। আসল ক্ষমতা কার হাতে? জামায়াতে ইসলাম এবং তাদের আদর্শিক মিত্র বিভিন্ন ওহাবি সংগঠনের হাতে।

এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে একের পর এক ঘটনা ঘটছে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে, হিন্দু মন্দির ভাঙা হচ্ছে, খ্রীষ্টানদের চার্চে বোমা হামলা হচ্ছে, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে আক্রমণ হচ্ছে, এখন বাউলশিল্পীদের পেটানো হচ্ছে। একটা প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে না? যারাই বাংলাদেশের উদার, সহনশীল, বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের ধারক, তাদের সবাইকে টার্গেট করা হচ্ছে। এটা কাকতালীয় নয়, এটা পরিকল্পিত। জামায়াতে ইসলাম এবং তাদের মিত্ররা জানে যে বাংলাদেশকে একটা মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে আগে এদেশের সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে ধ্বংস করতে হবে। আর সেই কাজটাই এখন চলছে পুরোদমে।

মানিকগঞ্জে যা ঘটেছে, তার বিবরণ পড়লে গা শিউরে ওঠে। একদিকে বাউলশিল্পীরা শান্তিপূর্ণভাবে জড়ো হয়েছিলেন আবুল সরকারের মুক্তির দাবিতে। অন্যদিকে তৌহিদী জনতা নামের একদল মৌলবাদী মিছিল নিয়ে এসে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাউলশিল্পীদের মারধর করা হয়, তাদের প্রাণ বাঁচাতে ডোবায় ঝাঁপ দিতে হয়। এই তৌহিদী জনতা কারা? এরা সেই একই লোক যারা জুলাইয়ে রাস্তায় নেমেছিল, যারা পুলিশ হত্যা করেছে, যারা সরকারি অফিস জ্বালিয়েছে। আর এখন ইউনুস সরকারের ছত্রছায়ায় এরা আইনের ঊর্ধ্বে।

প্রশাসন কী করলো? পুলিশ কোথায় ছিল যখন হামলা হচ্ছিল? উত্তর সহজ। পুলিশ জানতো এই হামলা হবে। প্রশাসন জানতো এই সংঘর্ষ হবে। কিন্তু তারা কিছু করেনি। কারণ ইউনুস সরকারের নির্দেশ এসেছে মৌলবাদীদের খুশি রাখার। যে সরকারের নিজের কোনো গণভিত্তি নেই, যে সরকার জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসেনি, তারা টিকে আছে শুধুমাত্র সামরিক সমর্থন আর মৌলবাদী শক্তির ওপর ভর করে। তাই জামায়াতের লোকজন যা করছে, তাদের সহযোগীরা যা করছে, সরকার চুপ। কারণ এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সরকারের ভিত্তিটাই নড়ে যাবে।

এখন প্রশ্ন হলো, জামায়াতে ইসলাম কেন এত মরিয়া বাউল-ফকিরদের নির্মূল করতে? কারণটা একদম স্পষ্ট। এই উপমহাদেশে ইসলামের যে রূপ দেখা যায়, সেটা মধ্যপ্রাচ্যের ওহাবি ইসলাম থেকে একদম আলাদা। এখানে ইসলাম এসেছে সুফী সাধকদের হাত ধরে। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী, নিজামুদ্দিন আউলিয়া, শাহজালাল, খানজাহান আলী এরা ইসলাম প্রচার করেছেন ভালোবাসা দিয়ে, সংগীত দিয়ে, মানবিকতা দিয়ে। এই সুফী ইসলামের সাথে হিন্দু-বৌদ্ধ ঐতিহ্যের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে বাংলার বাউল ধারা। এই ধারার কোনো সাম্প্রদায়িকতা নেই, কোনো কট্টরতা নেই। লালন শাহ বলেছিলেন, “সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে। লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।” এই যে উদার, মানবিক ইসলাম, এটাই জামায়াতে ইসলামের আসল শত্রু।

জামায়াত চায় বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা হোক সৌদি আরবের মতো কঠোর ওহাবি ইসলাম। যেখানে সংগীত হারাম, নাচ হারাম, শিল্পকলা হারাম, মুক্ত চিন্তা হারাম। যেখানে মানুষ রোবটের মতো শুধু একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে ঢালাই হয়ে বেরোবে। কিন্তু এই এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমে ধ্বংস করতে হবে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আর সেই ঐতিহ্যের সবচেয়ে বড় ধারক হলো বাউল, ফকির, সুফী সাধকরা। তাই এদের নিশ্চিহ্ন করা জামায়াতের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। মানিকগঞ্জে যা ঘটেছে, সেটা এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের একটা ধাপ মাত্র।

এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়। ওহাবিবাদ আসলে ইসলামের কোনো আদি রূপ নয়। এটা একটা আধুনিক রাজনৈতিক আন্দোলন যেটা শুরু হয়েছিল আঠারো শতকে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের হাত ধরে। আর এই মতবাদ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে খরচ করা হয়েছে সৌদি তেলের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশে হাজার হাজার মাদ্রাসা খোলা হয়েছে সৌদি টাকায়, যেখানে পড়ানো হচ্ছে ওহাবি মতবাদ। এই মতবাদের মূল কথা হলো অন্য সব মতামত, অন্য সব ব্যাখ্যা বাতিল। শুধুমাত্র তাদের ব্যাখ্যাই সঠিক, বাকি সবাই কাফের। এই মতবাদের ফসল হলো আল-কায়েদা, তালেবান, আইএস। আর বাংলাদেশে এই মতবাদের প্রধান বাহক জামায়াতে ইসলাম।

জামায়াতের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় এরা আসলে কারা। ১৯৭১ সালে এরা পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মিলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, গণহত্যা চালিয়েছে, বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছে। স্বাধীনতার পর এদের নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে সামরিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এরা আবার রাজনীতিতে ফিরে আসে। এরপর থেকে এরা একটাই কাজ করে আসছে। বাংলাদেশের সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক চরিত্র ধ্বংস করে এটাকে একটা ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করা। আর এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য এরা যে কোনো পথ বেছে নিতে প্রস্তুত। সন্ত্রাস, হত্যা, ক্যু যাই হোক না কেন।

জুলাইয়ের অভ্যুত্থান এই জামায়াতের জন্য একটা সোনালি সুযোগ এনে দিয়েছে। তারা এখন আর আন্ডারগ্রাউন্ডে নেই, তারা এখন প্রকাশ্যে রাস্তায়। তাদের লোকজন এখন প্রশাসনে ঢুকছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে ঢুকছে। আর তাদের মূল লক্ষ্য হলো একের পর এক বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চিহ্ন মুছে ফেলা। আজকে বাউলশিল্পী, কালকে রবীন্দ্রসংগীত, পরশু নাটক-সিনেমা। এভাবে এক এক করে সব কিছু নিষিদ্ধ করে দেওয়া হবে। আর তখন যা অবশিষ্ট থাকবে, সেটা আর বাংলাদেশ থাকবে না, সেটা হবে আফগানিস্তানের মতো আরেকটা তালেবানি রাষ্ট্র।

ইউনুস এই পুরো প্রকল্পে একটা হাতিয়ার মাত্র। তার খ্যাতি, তার আন্তর্জাতিক সংযোগ ব্যবহার করা হচ্ছে এই অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেওয়ার জন্য। কিন্তু মাঠে যারা কাজ করছে, আসল পরিকল্পনা যারা বাস্তবায়ন করছে, তারা হলো জামায়াত এবং তাদের মিত্ররা। ইউনুস হয়তো জানেন, হয়তো জানেন না, কিন্তু তার নামে যা হচ্ছে তার দায় তার। ইতিহাস তাকে মনে রাখবে সেই ব্যক্তি হিসেবে যিনি বাংলাদেশকে মৌলবাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের জন্মই হয়েছিল একটা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক শাসন আর ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এদেশের মানুষ স্বাধীনতা এনেছিল। কিন্তু এখন সেই একই শক্তি আবার মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। পার্থক্য শুধু এটুকু যে এবার তারা পাকিস্তানি পতাকা নয়, বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে এসেছে। কিন্তু তাদের আদর্শ একই, তাদের লক্ষ্য একই। বাংলাদেশকে একটা মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা।

মানিকগঞ্জের বাউলশিল্পীরা যারা ডোবায় ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন, তারা শুধু নিজেদের জন্য লড়ছেন না। তারা লড়ছেন বাংলাদেশের আত্মার জন্য, বাংলার সংস্কৃতির জন্য, এদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্যের জন্য। তারা প্রতিনিধিত্ব করছেন সেই বাংলাদেশের, যেখানে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই পাশাপাশি বাস করতে পারে, যেখানে গান-বাজনা-নাচ-শিল্প সবই স্বাভাবিক, যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে ভাবতে পারে, বলতে পারে। আর তাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে ইউনুস-জামায়াত চক্র, যারা চায় বাংলাদেশকে একটা অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিতে। এই লড়াই শুধু বাউলশিল্পীদের নয়, এটা পুরো বাংলাদেশের লড়াই। আর এই লড়াইয়ে হেরে গেলে যা হারাবে, তা আর কখনো ফিরে পাওয়া যাবে না।

আরো পড়ুন

সর্বশেষ