আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর তিনি এক লিখিত বিবৃতিতে রায়টিকে “কারচুপিপূর্ণ, পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার বক্তব্যে অভিযোগ তোলা হয় যে, অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত আইসিটি শুরু থেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরিচালিত হয়েছে এবং তাকে শেষ নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরিয়ে দেওয়া ও আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার লক্ষ্যেই এ রায় দেওয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে শেখ হাসিনা দাবি করেন, ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের শাসন বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা ও সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে পরিপূর্ণ। তার ভাষায়, জনগণ বুঝতে পারছে আইসিটির বিচার ন্যায়বিচারের জন্য নয়; বরং জুলাই–আগস্টের অস্থিরতার দায় আওয়ামী লীগের ওপর চাপাতে এবং সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে এই বিচার প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে।
তিনি অভিযোগ করেন, সরকারি সেবা ভেঙে পড়েছে, পুলিশ কার্যত রাস্তা থেকে সরে গেছে, বিচারব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে, আর আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বাড়লেও সেগুলো বিচারহীনতার মধ্যে চলছে। পাশাপাশি প্রশাসনে চরমপন্থী গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি, নির্বাচন বারবার পিছিয়ে দেওয়া এবং আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে নিষিদ্ধ করাও এই সরকারের স্বভাবসুলভ আচরণের অংশ। তার দাবি, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা এবং আইএমএফের প্রতিবেদনে এসব অবস্থার প্রমাণ মিলেছে। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ড. ইউনূসকে বাংলাদেশের জনগণ কখনো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আনেনি।
নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে তিনি জানান, গত বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ঘটে যাওয়া মৃত্যুর ঘটনা দেশের জন্য গভীর ট্র্যাজেডি, কিন্তু তিনি বা কোনো রাজনৈতিক নেতা কখনোই বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেননি। আদালতে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যার যথাযথ সুযোগ কিংবা অনুপস্থিতিতে পছন্দের আইনজীবী নিয়োগের সুযোগও তাকে দেওয়া হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি। আইসিটিকে তিনি নিরপেক্ষতা ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডহীন একটি আদালত হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, রায় আগেই ঠিক হয়ে ছিল এবং আদালত ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিচার কাঠামোকে রাজনৈতিক প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, তিনি বারবার হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) বিচার চাইলেও অন্তর্বর্তী সরকার কখনো এই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি, কারণ তারা জানে আইসিসি তাকে খালাস দেবে এবং বরং নিজেদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ড খতিয়ে দেখবে। তার ভাষায়, তার সরকার ছিল জনগণের ভোটে নির্বাচিত, আর ড. ইউনূস অসাংবিধানিকভাবে এবং চরমপন্থীদের সহায়তায় ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন।
বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ছাত্র, শ্রমিক, চিকিৎসক, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের আন্দোলন দমন করা হয়েছে, সাংবাদিকরা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিশোধমূলক হামলা চালানো হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ঘরবাড়ি–ব্যবসা পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। অপরাধীদের দায়মুক্তি দেওয়া হলেও আওয়ামী লীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে কারাগার ভরিয়ে তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
জুলাই–আগস্টের সহিংসতা সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, ছাত্রদের আন্দোলনের শুরুতে তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বিক্ষোভের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু জুলাইয়ের মাঝামাঝি কিছু বিক্ষোভকারী অবকাঠামো ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটায় পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তিনি দাবি করেন, আইসিটির উপস্থাপিত অডিও–ভিডিও প্রমাণ বিকৃত ও প্রাসঙ্গিকতা-বর্জিত, এবং এগুলোর মাধ্যমে তাকে দায়ী করার কোনো ভিত্তি নেই।
তিনি জাতিসংঘের উদ্ধৃত ১ হাজার ৪০০ মৃত্যুর পরিসংখ্যানের বিরোধিতা করে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যাচাইকৃত সংখ্যা ৮৩৪ জন, যার মধ্যেও অসংগতি রয়েছে। কিছু মৃত্যুর কারণ গুলি নয়, বরং অসুস্থতা ও দুর্ঘটনা—এমন অভিযোগও তোলেন তিনি। নিহতদের সরকারি তালিকা প্রকাশে সরকারের অনীহা প্রসঙ্গে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন। আরও জানান, তার সরকারের গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ইউনূস সরকার ক্ষমতায় এসে বন্ধ করে দেয়।
নিজ সরকারের মানবাধিকার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার সাফল্যের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশকে আইসিসিতে যোগদান করানো, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া এবং জিডিপিকে ৪৫০ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করার মতো অর্জন তার সরকারের মানবাধিকার প্রতিশ্রুতির প্রমাণ। তার মতে, এসব অর্জন কোনোভাবেই মানবাধিকার অবহেলার চিত্র তুলে ধরে না।
বিবৃতির শেষাংশে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ দেশের জনগণের হাতে, এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই মুক্ত, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও সবার জন্য উন্মুক্ত হতে হবে।

