নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড পোশাক শিল্প আজ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। গত এক বছরে প্রায় দুইশত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। হাজার হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া আর ভারতের দিকে ঝুঁকছেন। এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কে? যে অন্তর্বর্তী সরকার জুলাইয়ের রক্তাক্ত দাঙ্গার মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের অযোগ্যতা আর অদূরদর্শিতাই এই সংকটের মূল কারণ।
ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন এই তথাকথিত অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ভেঙে, নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে। জুলাইয়ের সেই ভয়াবহ সহিংসতায় দেশ জুড়ে যে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর আর নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল, তার ক্ষত এখনো শুকায়নি। সেই ঘটনার পর থেকে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, তাই আজ পোশাক শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক ক্রেতারা ব্যবসা করেন বিশ্বাস আর স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে। তাদের দরকার নির্ভরযোগ্য সরবরাহ শৃঙ্খল, সময়মতো পণ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা আর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করার মতো পরিবেশ। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ এসব কিছুই দিতে পারছে না। প্রতিদিন গ্যাসসংকট, লোডশেডিং আর অবকাঠামোগত বিপর্যয়ের খবর আসছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা দেশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো কেন বাংলাদেশে অর্ডার দেবে?
বিকেএমইএ, বিটিএমএ আর বিজিএমইএর নেতারা যখন বলছেন যে ক্রেতারা নতুন অর্ডার দিতে দ্বিধাগ্রস্ত, যখন তারা জানাচ্ছেন যে গার্মেন্ট খাত এখন সংকট ব্যবস্থাপনার খাতে পরিণত হয়েছে, তখন বুঝতে হবে পরিস্থিতি কতটা গুরুতর। এই শিল্পে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা আশি ভাগের বেশি আসে পোশাক খাত থেকে। এই খাত ধ্বংস হলে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে যাবে।
যে সরকার অর্থনীতির কোনো মৌলিক ধারণা ছাড়াই, কোনো জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই ক্ষমতায় এসেছে, তাদের কাছ থেকে কার্যকর সমাধান আশা করা বোকামি। ইউনুস সাহেব মাইক্রোক্রেডিট নিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু একটি দেশের জটিল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা আর ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম এক জিনিস নয়। দেশ পরিচালনার জন্য দরকার রাজনৈতিক বৈধতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আর জনগণের আস্থা। এই তিনটির কোনোটাই এই সরকারের নেই।
জুলাইয়ের দাঙ্গার পর থেকে দেশে একের পর এক ধর্মঘট, অবরোধ আর আন্দোলন হচ্ছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় নামছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভঙ্গুর। এই পরিবেশে কোনো কারখানা স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন চালাতে পারে না। রপ্তানিকারকরা বাধ্য হয়ে বিমানে পণ্য পাঠাচ্ছেন, যার খরচ স্বাভাবিক শিপমেন্টের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এতে তাদের লাভের মার্জিন শূন্যের কোঠায় নেমে আসছে। অনেক কারখানা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না, যা আর্থিক খাতেও নতুন সংকট তৈরি করছে।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এই সংকট সাময়িক নয়। একবার আন্তর্জাতিক ক্রেতারা যদি বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন আর অন্য দেশে সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরি করে ফেলেন, তাহলে তাদের ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত কঠিন হবে। ভিয়েতনাম আর ভারত ইতিমধ্যে এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। তারা বাংলাদেশের হারানো অর্ডারগুলো নিজেদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক বাজারে এই সুবিধা একবার হারালে ফিরে পাওয়া দুঃসাধ্য।
বর্তমান সরকারের কাছে এই সংকট মোকাবেলার কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানি সংকট সমাধানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। অবকাঠামো উন্নয়নে কোনো দীর্ঘমেয়াদী ভিশন নেই। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার কোনো রোডম্যাপ নেই। আছে শুধু খালি বুলি আর অজুহাত। তারা পূর্ববর্তী সরকারকে দোষারোপ করে সময় কাটাচ্ছেন, কিন্তু নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন।
পোশাক শিল্পের এই বিপর্যয় শুধু অর্থনৈতিক সংকট নয়, এটি একটি মানবিক বিপর্যয়ও। লাখ লাখ শ্রমিক, যাদের অধিকাংশই নারী, তাদের জীবিকা হারাচ্ছেন। এই শ্রমিকরা গ্রাম থেকে এসে শহরে স্বপ্ন দেখতে শিখেছিলেন। তারা নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে পরিবার চালাচ্ছিলেন। আজ সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কারখানা বন্ধ হলে তাদের সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ছাড়া আর কিছু নেই।
যারা জুলাইয সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন, যারা দেশের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ভেঙে ফেলেছেন, যারা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করেছেন, তারাই আজ পোশাক শিল্পের এই মৃত্যুর জন্য দায়ী। ইউনুস সাহেব আর তার দল হয়তো ভাবতে পারেন যে তারা সংস্কারের নামে কিছু করছেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো তারা দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প গত চার দশকে যে সুনাম আর বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করেছিল, তা একটি অবৈধ সরকারের এক বছরের অযোগ্য শাসনে ধুলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। এই ক্ষতি পূরণ করতে কয়েক যুগ লেগে যাবে। দেশের কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকারে। আর এই অন্ধকারের জন্য দায়ী তারাই, যারা ক্ষমতার লোভে দেশকে অস্থিরতার আগুনে ঝলসে দিয়েছেন।

