Wednesday, November 5, 2025

জনপ্রশাসন সংস্কারের মোয়া : প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতার ফারাক

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সংস্কারের বড় বড় কথা শোনা যাচ্ছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল বেশ ঘটা করেই। লক্ষ্য ছিল জনমুখী, দক্ষ আর জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তোলা। কিন্তু কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও কাগজে-কলমে থেকে যাওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলো এখনো বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। ২০৮টি সুপারিশের মধ্যে মাত্র তিনটি বাস্তবায়িত হয়েছে। এই তিনটির মধ্যে রয়েছে মহাসড়কের ফিলিং স্টেশনে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, পাসপোর্টকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি এবং সরকারি দপ্তরে নির্দিষ্ট বিরতিতে গণশুনানির ব্যবস্থা। প্রশ্ন হলো, বাকি সংস্কারগুলো কোথায় আটকে গেল?

গত বছরের অক্টোবরে কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবেদন জমা পড়েছে। এরপর মার্চে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মতামত চেয়ে চিঠি পাঠায়। জুনে এসে সরকার জানায় যে আশু বাস্তবায়নযোগ্য ১৮টি প্রস্তাব বাছাই করা হয়েছে। তার মধ্য থেকে আটটি অপেক্ষাকৃত সহজ প্রস্তাব নিয়ে কাজ শুরুর কথা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে কী হলো? আটের মধ্যে মাত্র তিনটি কোনোমতে বাস্তবায়ন হয়েছে, বাকিগুলো এখনো ফাইলবন্দি।

যে প্রস্তাবগুলো এখনো আলোর মুখ দেখেনি, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পুনর্গঠন, উপজেলা পরিষদ শক্তিশালীকরণ, ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস সংস্কার এবং পার্শ্বনিয়োগ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে প্রশাসনিক কাঠামোতে সত্যিকারের পরিবর্তন আসতে পারত। কিন্তু সেই পথে হাঁটার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমেদ নিজেই স্বীকার করেছেন যে প্রতিবেদন জমার পরই এসব বাস্তবায়ন শুরু করা যেত। কিন্তু কেন বিলম্ব হচ্ছে, তা তিনি জানেন না। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, দুর্ভাগ্যবশত জনপ্রশাসনের সমস্যা সমাধানে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। এমন মন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে শুধু প্রতিবেদন তৈরি করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

সাবেক সচিব এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, প্রশাসনিক সংস্কার বিষয়ক প্রতিবেদন সুচিন্তিত বা বাস্তবভিত্তিক হয়েছে বলে কোনো পক্ষই মনে করে না। ফলে এই প্রতিবেদন কোনো পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। এই মন্তব্য থেকে পরিষ্কার যে সংস্কার কমিশনের কাজ নিয়ে প্রশাসনের ভেতরেই প্রশ্ন রয়েছে।

অন্যদিকে সচিবালয়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, সংস্কার কমিশনগুলো জনপ্রশাসন সংস্কারের কথা বললেও কর্মচারীদের বিষয়ে কোনো কাজ করেনি। শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, গাড়ি-বাড়িসহ নানা সুবিধা বাড়লেও নিচের পদের কর্মচারীদের কিছুই হয়নি। এই অভিযোগও উপেক্ষা করার মতো নয়। সংস্কার যদি শুধু ওপরতলার মানুষদের জন্য হয়, তাহলে তার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে কীভাবে?

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এম রায়হান আখতার বলেছেন, গত দুই মাস তিনি প্রশিক্ষণে ছিলেন, তাই সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে কাজ করতে পারেননি। এই ধরনের জবাব শুনলে বিস্মিত হতেই হয়। সংস্কারের দায়িত্ব যদি এতই গুরুত্বহীন হয় যে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা দুই মাস প্রশিক্ষণে চলে যেতে পারেন, তাহলে সংস্কারের আসল অবস্থা বোঝা কঠিন নয়।

বাংলাদেশে প্রশাসনিক সংস্কারের ইতিহাস দীর্ঘ। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রশাসনিক পুনর্গঠনের জন্য কমিটি গঠন করেছিলেন। পরবর্তী বছরগুলোতেও একাধিক কমিশন গঠিত হয়েছে। বিশেষত ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসন সংস্কার কমিশন এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে, যার লক্ষ্য ছিল স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা। ২০০৯ সালে কর্মদক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছিল। এসব উদ্যোগের ফলে প্রশাসনে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছিল। ই-সেবা চালু, ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেবা প্রদান, জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং স্বচ্ছতার দিকে অগ্রগতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এত কমিশন, এত আলোচনা, এত প্রতিশ্রুতির পরেও মূল সংস্কারগুলো কাগজেই রয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠছে, আসলে কি সংস্কারের ইচ্ছা আছে, নাকি শুধুই দেখানোর জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে? সংস্কারের নামে অযথা সময় নষ্ট করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আর এই সময় নষ্টের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে, যারা আসলে প্রশাসনিক সেবার মান উন্নতি দেখতে চায়।

সংস্কারের গতি দেখে মনে হচ্ছে যেন এটি একটি প্রক্রিয়া মাত্র, ফলাফল নয়। কাগজে-কলমে সবকিছু করা হচ্ছে, কিন্তু মাঠে কিছুই ঘটছে না। যেসব সংস্কার জনগণের জীবনে সত্যিকারের প্রভাব ফেলতে পারত, সেগুলোই বাদ পড়ে যাচ্ছে। হয়তো এই সরকারের প্রশাসনিক সংস্কারের ব্যাপারে আগ্রহের চেয়ে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার আগ্রহই বেশি। সংস্কার হোক বা না হোক, কমিশন তো গঠন করা গেছে, প্রতিবেদন তো জমা পড়েছে, এটুকুই যথেষ্ট বলে মনে করা হচ্ছে হয়তো। কিন্তু এই ধরনের প্রহসন দিয়ে মানুষের আস্থা ফেরানো সম্ভব নয়।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সংস্কারের বড় বড় কথা শোনা যাচ্ছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল বেশ ঘটা করেই। লক্ষ্য ছিল জনমুখী, দক্ষ আর জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তোলা। কিন্তু কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও কাগজে-কলমে থেকে যাওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলো এখনো বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। ২০৮টি সুপারিশের মধ্যে মাত্র তিনটি বাস্তবায়িত হয়েছে। এই তিনটির মধ্যে রয়েছে মহাসড়কের ফিলিং স্টেশনে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, পাসপোর্টকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি এবং সরকারি দপ্তরে নির্দিষ্ট বিরতিতে গণশুনানির ব্যবস্থা। প্রশ্ন হলো, বাকি সংস্কারগুলো কোথায় আটকে গেল?

গত বছরের অক্টোবরে কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবেদন জমা পড়েছে। এরপর মার্চে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মতামত চেয়ে চিঠি পাঠায়। জুনে এসে সরকার জানায় যে আশু বাস্তবায়নযোগ্য ১৮টি প্রস্তাব বাছাই করা হয়েছে। তার মধ্য থেকে আটটি অপেক্ষাকৃত সহজ প্রস্তাব নিয়ে কাজ শুরুর কথা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে কী হলো? আটের মধ্যে মাত্র তিনটি কোনোমতে বাস্তবায়ন হয়েছে, বাকিগুলো এখনো ফাইলবন্দি।

যে প্রস্তাবগুলো এখনো আলোর মুখ দেখেনি, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পুনর্গঠন, উপজেলা পরিষদ শক্তিশালীকরণ, ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস সংস্কার এবং পার্শ্বনিয়োগ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে প্রশাসনিক কাঠামোতে সত্যিকারের পরিবর্তন আসতে পারত। কিন্তু সেই পথে হাঁটার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমেদ নিজেই স্বীকার করেছেন যে প্রতিবেদন জমার পরই এসব বাস্তবায়ন শুরু করা যেত। কিন্তু কেন বিলম্ব হচ্ছে, তা তিনি জানেন না। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, দুর্ভাগ্যবশত জনপ্রশাসনের সমস্যা সমাধানে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। এমন মন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে শুধু প্রতিবেদন তৈরি করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

সাবেক সচিব এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, প্রশাসনিক সংস্কার বিষয়ক প্রতিবেদন সুচিন্তিত বা বাস্তবভিত্তিক হয়েছে বলে কোনো পক্ষই মনে করে না। ফলে এই প্রতিবেদন কোনো পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। এই মন্তব্য থেকে পরিষ্কার যে সংস্কার কমিশনের কাজ নিয়ে প্রশাসনের ভেতরেই প্রশ্ন রয়েছে।

অন্যদিকে সচিবালয়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, সংস্কার কমিশনগুলো জনপ্রশাসন সংস্কারের কথা বললেও কর্মচারীদের বিষয়ে কোনো কাজ করেনি। শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, গাড়ি-বাড়িসহ নানা সুবিধা বাড়লেও নিচের পদের কর্মচারীদের কিছুই হয়নি। এই অভিযোগও উপেক্ষা করার মতো নয়। সংস্কার যদি শুধু ওপরতলার মানুষদের জন্য হয়, তাহলে তার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে কীভাবে?

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এম রায়হান আখতার বলেছেন, গত দুই মাস তিনি প্রশিক্ষণে ছিলেন, তাই সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে কাজ করতে পারেননি। এই ধরনের জবাব শুনলে বিস্মিত হতেই হয়। সংস্কারের দায়িত্ব যদি এতই গুরুত্বহীন হয় যে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা দুই মাস প্রশিক্ষণে চলে যেতে পারেন, তাহলে সংস্কারের আসল অবস্থা বোঝা কঠিন নয়।

বাংলাদেশে প্রশাসনিক সংস্কারের ইতিহাস দীর্ঘ। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রশাসনিক পুনর্গঠনের জন্য কমিটি গঠন করেছিলেন। পরবর্তী বছরগুলোতেও একাধিক কমিশন গঠিত হয়েছে। বিশেষত ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসন সংস্কার কমিশন এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে, যার লক্ষ্য ছিল স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা। ২০০৯ সালে কর্মদক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছিল। এসব উদ্যোগের ফলে প্রশাসনে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছিল। ই-সেবা চালু, ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেবা প্রদান, জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং স্বচ্ছতার দিকে অগ্রগতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এত কমিশন, এত আলোচনা, এত প্রতিশ্রুতির পরেও মূল সংস্কারগুলো কাগজেই রয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠছে, আসলে কি সংস্কারের ইচ্ছা আছে, নাকি শুধুই দেখানোর জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে? সংস্কারের নামে অযথা সময় নষ্ট করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আর এই সময় নষ্টের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে, যারা আসলে প্রশাসনিক সেবার মান উন্নতি দেখতে চায়।

সংস্কারের গতি দেখে মনে হচ্ছে যেন এটি একটি প্রক্রিয়া মাত্র, ফলাফল নয়। কাগজে-কলমে সবকিছু করা হচ্ছে, কিন্তু মাঠে কিছুই ঘটছে না। যেসব সংস্কার জনগণের জীবনে সত্যিকারের প্রভাব ফেলতে পারত, সেগুলোই বাদ পড়ে যাচ্ছে। হয়তো এই সরকারের প্রশাসনিক সংস্কারের ব্যাপারে আগ্রহের চেয়ে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার আগ্রহই বেশি। সংস্কার হোক বা না হোক, কমিশন তো গঠন করা গেছে, প্রতিবেদন তো জমা পড়েছে, এটুকুই যথেষ্ট বলে মনে করা হচ্ছে হয়তো। কিন্তু এই ধরনের প্রহসন দিয়ে মানুষের আস্থা ফেরানো সম্ভব নয়।

আরো পড়ুন

সর্বশেষ