নিজস্ব প্রতিবেদক
ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ বন্দি নিয়ে চলছে দেশের ৬৮টি কারাগার। কারা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের কারাগারগুলোয় ৪৬ হাজার বন্দির ধারণক্ষমতা রয়েছে। গত সোমবার (২৭ অক্টোবর) পর্যন্ত এসব কারাগারে বন্দি ছিল প্রায় ৮০ হাজার। তাদের মধ্যে ৭৩ দশমিক ৭৫ শতাংশেরই এখনো বিচার শেষ হয়নি। এমনকি অনেক বন্দির এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকাজও শুরু হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব বন্দির বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ সমর্থক। যাদেরকে মিথ্যা মামলায় জামিন ছাড়াই দিনের পর দিন কারাগারে আটক রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমিত জায়গার মধ্যে অনেক বেশি বন্দি রাখতে গিয়ে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারছে না কারা কর্তৃপক্ষ। এতে কারো কারো দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি বিচারিক দীর্ঘসূত্রতায় এসব বন্দির বড় একটি অংশ দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারছেন না।
গত এক বছরে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের অন্তত ২৬ জন নেতাকর্মী কারাগারে, পুলিশের হেফাজতে বা অভিযান চলাকালে নিহত হয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নাশকতা ও সহিংসতার অভিযোগ ছিল, যেগুলোর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে পরিবারের সদস্য ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এরইমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপির ডিভিশন বাতিল করা হয়েছে। অনেকেই চিকিৎসাও পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর জেলে তাদের ওপর নিয়মিত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়, খাবারের সাথে অজানা ক্যামিকেল এবং মেডিসিন মিশিয়ে অথবা জোর করে খাওয়ানো হয়। যদি কেউ অস্বীকৃতি জানায়, তাহলেই তার উপর নেমে আসে মধ্যযুগীয় বর্বরোচিত নির্যাতন। এই হত্যার পদ্ধতি এতোই নিখুঁত যে, তা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়া বোঝার কোনো উপায়ই নেই বাইরে থেকে দেখে।
ডিজিটালিস গ্রুপের ওষুধ, যেমন ডিজক্সিন Digoxin বা Digitoxin, মূলত Foxglove গাছ থেকে তৈরি এবং ডাক্তাররা হার্টের রোগ, বিশেষ করে হার্ট ফেইলিওর বা অ্যারিদমিয়া নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করেন। এই ওষুধ হার্টকে শক্তভাবে সংকুচিত হতে সাহায্য করে, যা সঠিক মাত্রায় নেওয়া হলে জীবন রক্ষাকারী। কিন্তু মাত্রা একটু বেশি হলেই হার্টবিট অনিয়মিত হয়ে যায়, যা অ্যারিদমিয়া নামে পরিচিত। বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা, দৃষ্টির অস্বাভাবিকতা—এই লক্ষণগুলোও দেখা দেয়। যদি এই ওষুধ সামান্য বেশি ডোজ দেওয়া হয়, তাহলে ধীরে ধীরে শরীরে জমে কয়েকদিন পর হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট ঘটতে পারে। বাইরের দিকে কোনো চিহ্ন থাকে না।
ডিজিটালিস বা ডিজক্সিন অতিরিক্ত ডোজ দিলে শরীরে শোষিত হয়ে প্রভাব কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শুরু হয়। খুব বেশি ডোজ হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গুরুতর অ্যারিদমিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট দেখা দিতে পারে, আবার ধীরে ধীরে জমলে কয়েকদিন পর লক্ষণ প্রকাশ পায়। ফরেনসিক বা টক্সিকোলজি টেস্ট না থাকলে এসব মৃত্যু প্রায়ই প্রাকৃতিক কার্ডিয়াক অ্যাটাকের মতো মনে হয়।
এই ওষুধগুলোকে বন্দীদের খাবারের সাথে মিশিয়ে অজান্তে বা জোরপূর্বক খাওয়ানো হয়। তিন দিনের মধ্যে, কখনও বা ৮-২৪ ঘন্টার মধ্যে, তারা মারা যায়। সূত্র বলছে, এরপরই পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয় যে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় কোনো দৃশ্যমান চিহ্ন থাকে না, কোনো ক্ষতি বোঝা যায় না, সবকিছু সাজানো এবং নিখুঁত।
জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ ও ডয়চেভেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রেপ্তার হওয়ার পর কারাগারে থাকা সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক হার্ট অ্যাটাক করেন। গত ডিসেম্বরে ‘হার্ট অ্যাটাকে’ বগুড়া কারাগারে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মতিন ওরফে মিঠুর মৃত্যু হয়। এর আগে নভেম্বরে বগুড়ায় কারাগারে হার্ট অ্যাটাক (হৃদরোগে আক্রান্ত) হওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার পথে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শাহাদত আলম ঝুনু (৬০) মারা যান।
জানা গেছে, গত নভেম্বর ডিসেম্বরে বগুড়ায় কারাগারে চার আওয়ামী লীগ নেতার হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, “কারাগারে এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু যদি সত্যিই পরিকল্পিতভাবে ঘটে থাকে, তাহলে এটি শুধু এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, বরং রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর গভীর আঘাত। এটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতার জন্য বড় ইঙ্গিত। সরকারের উচিত অবিলম্বে স্বচ্ছ এবং স্বাধীন তদন্ত নিশ্চিত করা।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশের কারাগারে যেসব বন্দি রয়েছেন, তাদের বড় একটি অংশ বিচারাধীন। এমনকি এর মধ্যে বড় একটি অংশের আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকাজ শুরুই হয়নি। কারাগারগুলোর যে ধারণক্ষমতা, তার চেয়ে অনেক বেশি বন্দি রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘কারাগারে বন্দি রেখে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এজন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করে অপরাধীকে তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ভুক্তভোগীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন বিচারাঙ্গনের সঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষের একটি অর্থপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন।’

 
                                    