Wednesday, December 17, 2025

বিজয় সুসংহত করতে হবে

এম. নজরুল ইসলাম
আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনের দিন, সবচেয়ে আনন্দের দিন, সবচেয়ে গৌরবের দিন এই বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠেছিল বাংলাদেশ। এই দিনটিতেই বাঙালি জাতি প্রথমবার প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করেছিল। বাংলার আকাশে পত পত করে উড়েছিল লাল-সবুজের প্রিয় পতাকা। বিশ্বের মানচিত্রে একটি গর্বিত জাতি হিসেবে স্থান করে নিয়েছিল বাংলাদেশ।

দীর্ঘ পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর দীর্ঘ নয় মাস ধরে চলে মুক্তিযুদ্ধ। এই সময়ে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আল বদর-আল শামস বাহিনীর সদস্যদের অত্যাচার-নির্যাতন পৃথিবীর ইতিহাসের সব বর্বরতাকে হার মানিয়েছিল। হায়েনার মতো তারা নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সারা দেশের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে তারা টিকতে পারেনি। এর আগে ১৯৭১ সালের সাতই মার্চের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করেই ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেদিন থেকেই মুক্তিপাগল বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠারর থেকেই শুরু হয় পাকিস্তানিদের দুঃশাসন। বাঙালিদের ওপর নেমে আসে শোষণ ও বঞ্চনার খড়গ। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশই ছিল বাঙালি, অথচ তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার হতে হয়। সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের স্থান ছিল না বললেই চলে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসন ছাড়াও প্রাদেশিক সরকারের প্রশাসনেও ছিল অবাঙালি আমলাদের প্রাধান্য।

প্রথমেই তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র শুরু করে। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হয়, যার প্রতিবাদে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ঢাকার রাজপথ রক্তাক্ত হয়। ক্রমে পাকিস্তানিদের হীন চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাঙালিরা প্রতিবাদমুখর হতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান।

সর্বশেষ ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় পায় (পুরো পাকিস্তানের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন)। কিন্তু পাকিস্তানিরা বাঙালির হাতে পাকিস্তানের শাসনভার দেবে না। শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ, নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত মানুষের ওপর ট্যাংক, কামান, মেশিনগান নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী। কামানের গোলা আর মেশিনগানের বিকট শব্দ রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে দেয়। অগনিত মানুষের রক্তের স্রোত বয়ে যায়। তাদের আর্তচিৎকারে আকাশ বিদীর্ণ হয়।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসা থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা কিছুক্ষণ আগেই তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেসযোগে প্রচার করা হয়। সেই রাতেই ঢাকার বলধা গার্ডেনে স্থাপিত এক গোপন রেডিও ট্রান্সমিটার থেকেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রচার করা হয়। ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এটা হয়তো-বা আমার শেষ বার্তা।

আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহবান জানাচ্ছি-আপনারা যে যেখানে আছেন এবং আপনাদের হাতে যার যা আছে তাই নিয়ে হানাদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত না হওয়া এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। খোদা হাফেজ-জয় বাংলা।’ তারপর ঢাকার মগবাজার টিঅ্যান্ডটি অফিস থেকে গোপনে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি সারা দেশে পাঠানো হয়।

২৫ মার্চ রাত ১২টা ১৫ মিনিটে স্বাধীনতা ঘোষণার ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রামে পৌঁছায়। তারপর চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ দুপুর ২টায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথম প্রচার করেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা তৎকালীন এমএনএ এম. এ. হান্নান। পরদিন ২৭ মার্চ, সন্ধ্যা ৭টায় ঐ বেতার কেন্দ্র থেকেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন তৎকালীন অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার এটাই প্রেক্ষাপট।

বাংলার দামাল ছেলেরা অদম্য মনোবল আর বুকভরা সাহস নিয়ে রুখে দাঁড়ায় অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীকে। অত্যাধুনিক অস্ত্র না থাকলেও তাদের ছিল অদম্য মনোবল। প্রতিজ্ঞা ছিল: জীবন দেব, তবু বাংলা দেব না। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলে মরণপণ যুদ্ধ। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর কয়েক লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অবশেষে আসে সেই ঐতিহাসিক বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরেরা জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করে। তাই ঐতিহাসিক এই বিজয় যেমন গৌরবের, সীমাহীন আনন্দের, একই সঙ্গে এই বিজয় স্বজন হারানোর অতলস্পর্শী বেদনারও।

পাকবাহিনী ও তাদের দোসরেরা সেদিন আত্মসমর্পণ করলেও তারা হিংসা ছাড়েনি। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকে। জামায়াত, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামীর অনুসারীরা সুযোগ খুঁজতে থাকে। গুপ্ত হত্যাকারী ও গোপন দলের আশ্রয়ে দেশব্যাপী ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালাতে শুরু করে। আর মোশতাক-জিয়া চক্র জাতির জনককে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতাবিরোধীদের এ দেশে রাজনীতি করার তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে তাদের প্রতিশোধ-ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধকারী কিছু রাজাকার-আলবদর নেতার ফাঁসি হয়। তাতে তাদের প্রতিশোধস্পৃহা আরো বেড়ে যায়।

২০২৪ সালে এসে তারা সফল হয়। দেশি-বিদেশি সহায়তায় ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইন’ করা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশে ভয়াবহ দাঙ্গা সৃষ্টি করা হয়। ব্যাপক অগ্নিসন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালানো হয়। জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার বাহিনী এবং জঙ্গীরা পুলিশ ফাঁরি ও জেলখানায় হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুট করে। আটক জঙ্গীদের ছাড়িয়ে নেয়। তারা সাড়ে তিন হাজার পুলিশ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীকে হত্যা করে। সেনাবাহিনী সেই ষড়যন্ত্রে প্রচ্ছন্ন মদদ দেয়। অবশেষে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে এবং শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়।

বর্তমানে জামায়াত, বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন ও কিছু মৌলবাদী দল ইউনূসের নেতৃত্বে দেশ চালাচ্ছে। ব্যাপক হারে ইসলামি মিলিশিয়া তৈরি করছে। উদ্দেশ্য, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশোধ নেওয়া। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠনগুলো বাংলাদেশে তাদের শাখা তৈরি করছে। অসংখ্য পাকিস্তানি জঙ্গি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারা তাদের অনুসারী বানাচ্ছে। সুইসাইড স্কোয়াড সাজাচ্ছে। আর সব কিছুর পরিকল্পনায় রয়েছে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী আরো কিছু দেশের আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা।

বাস্তবতাকে অস্বীকার করে লাভ নেই। চোখ ঘুরিয়ে রাখা কিংবা না দেখার ভান করেও লাভ হয় না। সাহস, পরিকল্পনা ও যথাযথ প্রস্তুতির মাধ্যমে পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে হয়। স্বাধীনতাবিরোধীরা মানুষকে ভুল বুঝিয়ে, ধোকা দিয়ে দেশের ক্ষমতা হাতে নিয়েছে। এখন ‘রিসেট বাটন টিপে’ মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন মুছে দিতে চায়। এদের এ কয়দিনের কর্মকাণ্ডে তা দিনের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। এরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। মুজিবনগরসহ সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ও ভাস্কর্য ধ্বংস করছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি, কবরস্থানে পর্যন্ত হামলা ও ভাংচুর চালিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় জুতার মালা পরিয়ে অসম্মানিত করছে, নির্যাতন করছে। মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা করছে। এরা বাহাত্তরের সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে। এরপর পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতে আঘাত করবে। বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তান বানাতে চাইবে। আর এ জন্য ওরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে সমূলে বিনাশ করতে চাইছে। একাত্তরের মতোই যুদ্ধ ও গণহত্যা পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তাই, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে তাদের গন্তব্য, পরিকল্পনা ও পরিণতি অনুধাবন করতে হবে। আর সেভাবেই নিজেদের পরিকল্পনা সাজাতে হবে, প্রস্তুতি নিতে হবে। একাত্তরের মতোই আবার এই ঘৃণ্য রাজাকার-আলবদরের উত্তরসূরী জামায়াতি ও জঙ্গিদের প্রতিরোধ করতে হবে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।

আজ মহান বিজয় দিবসে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করি জাতীয় চার নেতাকে। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই ৩০ লাখ শহীদ এবং সম্ভ্রমহারা মা-বোনদের। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এবং মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী দেশি ও বিদেশি সবাইকে।

লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি, অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী, লেখক, সাংবাদিক।

এম. নজরুল ইসলাম
আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনের দিন, সবচেয়ে আনন্দের দিন, সবচেয়ে গৌরবের দিন এই বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠেছিল বাংলাদেশ। এই দিনটিতেই বাঙালি জাতি প্রথমবার প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করেছিল। বাংলার আকাশে পত পত করে উড়েছিল লাল-সবুজের প্রিয় পতাকা। বিশ্বের মানচিত্রে একটি গর্বিত জাতি হিসেবে স্থান করে নিয়েছিল বাংলাদেশ।

দীর্ঘ পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর দীর্ঘ নয় মাস ধরে চলে মুক্তিযুদ্ধ। এই সময়ে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আল বদর-আল শামস বাহিনীর সদস্যদের অত্যাচার-নির্যাতন পৃথিবীর ইতিহাসের সব বর্বরতাকে হার মানিয়েছিল। হায়েনার মতো তারা নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সারা দেশের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে তারা টিকতে পারেনি। এর আগে ১৯৭১ সালের সাতই মার্চের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করেই ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেদিন থেকেই মুক্তিপাগল বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠারর থেকেই শুরু হয় পাকিস্তানিদের দুঃশাসন। বাঙালিদের ওপর নেমে আসে শোষণ ও বঞ্চনার খড়গ। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশই ছিল বাঙালি, অথচ তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার হতে হয়। সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের স্থান ছিল না বললেই চলে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসন ছাড়াও প্রাদেশিক সরকারের প্রশাসনেও ছিল অবাঙালি আমলাদের প্রাধান্য।

প্রথমেই তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র শুরু করে। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হয়, যার প্রতিবাদে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ঢাকার রাজপথ রক্তাক্ত হয়। ক্রমে পাকিস্তানিদের হীন চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাঙালিরা প্রতিবাদমুখর হতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান।

সর্বশেষ ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় পায় (পুরো পাকিস্তানের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন)। কিন্তু পাকিস্তানিরা বাঙালির হাতে পাকিস্তানের শাসনভার দেবে না। শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ, নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত মানুষের ওপর ট্যাংক, কামান, মেশিনগান নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী। কামানের গোলা আর মেশিনগানের বিকট শব্দ রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে দেয়। অগনিত মানুষের রক্তের স্রোত বয়ে যায়। তাদের আর্তচিৎকারে আকাশ বিদীর্ণ হয়।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসা থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা কিছুক্ষণ আগেই তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেসযোগে প্রচার করা হয়। সেই রাতেই ঢাকার বলধা গার্ডেনে স্থাপিত এক গোপন রেডিও ট্রান্সমিটার থেকেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রচার করা হয়। ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এটা হয়তো-বা আমার শেষ বার্তা।

আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহবান জানাচ্ছি-আপনারা যে যেখানে আছেন এবং আপনাদের হাতে যার যা আছে তাই নিয়ে হানাদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত না হওয়া এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। খোদা হাফেজ-জয় বাংলা।’ তারপর ঢাকার মগবাজার টিঅ্যান্ডটি অফিস থেকে গোপনে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি সারা দেশে পাঠানো হয়।

২৫ মার্চ রাত ১২টা ১৫ মিনিটে স্বাধীনতা ঘোষণার ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রামে পৌঁছায়। তারপর চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ দুপুর ২টায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথম প্রচার করেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা তৎকালীন এমএনএ এম. এ. হান্নান। পরদিন ২৭ মার্চ, সন্ধ্যা ৭টায় ঐ বেতার কেন্দ্র থেকেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন তৎকালীন অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার এটাই প্রেক্ষাপট।

বাংলার দামাল ছেলেরা অদম্য মনোবল আর বুকভরা সাহস নিয়ে রুখে দাঁড়ায় অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীকে। অত্যাধুনিক অস্ত্র না থাকলেও তাদের ছিল অদম্য মনোবল। প্রতিজ্ঞা ছিল: জীবন দেব, তবু বাংলা দেব না। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলে মরণপণ যুদ্ধ। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর কয়েক লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অবশেষে আসে সেই ঐতিহাসিক বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরেরা জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করে। তাই ঐতিহাসিক এই বিজয় যেমন গৌরবের, সীমাহীন আনন্দের, একই সঙ্গে এই বিজয় স্বজন হারানোর অতলস্পর্শী বেদনারও।

পাকবাহিনী ও তাদের দোসরেরা সেদিন আত্মসমর্পণ করলেও তারা হিংসা ছাড়েনি। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকে। জামায়াত, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামীর অনুসারীরা সুযোগ খুঁজতে থাকে। গুপ্ত হত্যাকারী ও গোপন দলের আশ্রয়ে দেশব্যাপী ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালাতে শুরু করে। আর মোশতাক-জিয়া চক্র জাতির জনককে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতাবিরোধীদের এ দেশে রাজনীতি করার তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে তাদের প্রতিশোধ-ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধকারী কিছু রাজাকার-আলবদর নেতার ফাঁসি হয়। তাতে তাদের প্রতিশোধস্পৃহা আরো বেড়ে যায়।

২০২৪ সালে এসে তারা সফল হয়। দেশি-বিদেশি সহায়তায় ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইন’ করা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশে ভয়াবহ দাঙ্গা সৃষ্টি করা হয়। ব্যাপক অগ্নিসন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালানো হয়। জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার বাহিনী এবং জঙ্গীরা পুলিশ ফাঁরি ও জেলখানায় হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুট করে। আটক জঙ্গীদের ছাড়িয়ে নেয়। তারা সাড়ে তিন হাজার পুলিশ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীকে হত্যা করে। সেনাবাহিনী সেই ষড়যন্ত্রে প্রচ্ছন্ন মদদ দেয়। অবশেষে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে এবং শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়।

বর্তমানে জামায়াত, বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন ও কিছু মৌলবাদী দল ইউনূসের নেতৃত্বে দেশ চালাচ্ছে। ব্যাপক হারে ইসলামি মিলিশিয়া তৈরি করছে। উদ্দেশ্য, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশোধ নেওয়া। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠনগুলো বাংলাদেশে তাদের শাখা তৈরি করছে। অসংখ্য পাকিস্তানি জঙ্গি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারা তাদের অনুসারী বানাচ্ছে। সুইসাইড স্কোয়াড সাজাচ্ছে। আর সব কিছুর পরিকল্পনায় রয়েছে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী আরো কিছু দেশের আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা।

বাস্তবতাকে অস্বীকার করে লাভ নেই। চোখ ঘুরিয়ে রাখা কিংবা না দেখার ভান করেও লাভ হয় না। সাহস, পরিকল্পনা ও যথাযথ প্রস্তুতির মাধ্যমে পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে হয়। স্বাধীনতাবিরোধীরা মানুষকে ভুল বুঝিয়ে, ধোকা দিয়ে দেশের ক্ষমতা হাতে নিয়েছে। এখন ‘রিসেট বাটন টিপে’ মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন মুছে দিতে চায়। এদের এ কয়দিনের কর্মকাণ্ডে তা দিনের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। এরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। মুজিবনগরসহ সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ও ভাস্কর্য ধ্বংস করছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি, কবরস্থানে পর্যন্ত হামলা ও ভাংচুর চালিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় জুতার মালা পরিয়ে অসম্মানিত করছে, নির্যাতন করছে। মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা করছে। এরা বাহাত্তরের সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে। এরপর পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতে আঘাত করবে। বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তান বানাতে চাইবে। আর এ জন্য ওরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে সমূলে বিনাশ করতে চাইছে। একাত্তরের মতোই যুদ্ধ ও গণহত্যা পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তাই, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে তাদের গন্তব্য, পরিকল্পনা ও পরিণতি অনুধাবন করতে হবে। আর সেভাবেই নিজেদের পরিকল্পনা সাজাতে হবে, প্রস্তুতি নিতে হবে। একাত্তরের মতোই আবার এই ঘৃণ্য রাজাকার-আলবদরের উত্তরসূরী জামায়াতি ও জঙ্গিদের প্রতিরোধ করতে হবে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।

আজ মহান বিজয় দিবসে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করি জাতীয় চার নেতাকে। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই ৩০ লাখ শহীদ এবং সম্ভ্রমহারা মা-বোনদের। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এবং মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী দেশি ও বিদেশি সবাইকে।

লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি, অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী, লেখক, সাংবাদিক।

আরো পড়ুন

সর্বশেষ