দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস একটি কঠিন সত্য বারবার সামনে এনেছে—ধর্মীয় পরিচয় কখনোই ন্যায়বিচার, সমতা কিংবা মানবিক মর্যাদার নিশ্চয়তা দেয় না। রাষ্ট্র যদি বৈষম্য, শোষণ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করে, তবে ধর্মীয় স্লোগান কেবল শাসনের ঢাল হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৩ বছরের সম্পর্ক তারই নির্মম প্রমাণ।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক অবদান সত্ত্বেও পরিকল্পিত বৈষম্যের শিকার হয়। রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রা ও কাঁচামালের বড় অংশ পূর্ব পাকিস্তান থেকে এলেও রাষ্ট্রীয় বাজেট, শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হয়েও বাঙালিদের রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ ছিল সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত।
একই রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে থেকেও পূর্ব পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে, আর পশ্চিম পাকিস্তান সেই অর্থনৈতিক লুটপাটের সুবিধা নিয়ে এগিয়ে যায়। সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে বাঙালিদের উচ্চপদে প্রবেশ কার্যত রুদ্ধ ছিল। এমনকি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেও এই বৈষম্য চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। এটি কোনো রাজনৈতিক ভুল নয়; এটি ছিল রাষ্ট্রীয় শাসননীতির সচেতন সিদ্ধান্ত।
মানবিক সংকটের সময় এই বৈষম্য আরও নগ্নভাবে প্রকাশ পায়। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও দুর্ভিক্ষে লক্ষ মানুষের মৃত্যু হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল অবহেলাপূর্ণ। অথচ রাজনৈতিক দাবি দমনে সামরিক শক্তি ব্যবহারে কোনো দ্বিধা ছিল না। এর পরিণতি হিসেবে ১৯৭১ সালে সংঘটিত হয় ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যা। তখন স্পষ্ট হয়ে যায়—“ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব” ছিল বাস্তবে একটি রাজনৈতিক প্রতারণা।
এই অভিজ্ঞতা কেবল বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, পশতুন অঞ্চল কিংবা আজাদ কাশ্মীর পাকিস্তান রাষ্ট্রের আচরণ সর্বত্র একই রকম। ধর্মের নামে আধিপত্য কায়েম করে ভিন্ন জাতিসত্তা ও জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অধিকার দমন করা হয়েছে। ফলে প্রশ্নটি ধর্মীয় নয়, বরং রাষ্ট্রীয় চরিত্র ও ক্ষমতার ব্যবহারের।
আজও যখন কেউ মুক্তিযুদ্ধকে ষড়যন্ত্র বা বাইরের প্রভাব হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে, তখন তা ইতিহাস অস্বীকারের শামিল। মুক্তিযুদ্ধ ছিল কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়; এটি ছিল দীর্ঘ ২৩ বছরের শোষণ, বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে জনগণের অনিবার্য বিদ্রোহ। এই সত্য অস্বীকার করা মানে শহীদদের আত্মত্যাগকে অস্বীকার করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা।
বাংলাদেশের জন্য এই ইতিহাস আজও প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি হতে হবে নাগরিকের সমতা, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা কোনো ধর্মীয় স্লোগান দিয়ে অন্যায় ঢাকার সুযোগ নেই। গণতন্ত্র, অধিকার ও সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর মধ্যেই একটি জাতির আত্মমর্যাদা নিহিত।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সেই শিক্ষাই দেয় যেখানে শোষণ দীর্ঘস্থায়ী হয়, সেখানে বিদ্রোহ অনিবার্য। ইতিহাসকে বিকৃত নয়, বরং সাহসের সঙ্গে স্বীকার করাই একটি জাতির প্রকৃত শক্তি।

