সুলতানা কামালের এই স্বীকারোক্তিটা আসলে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির একটা নিখুঁত ছবি। একজন আজীবন মানবাধিকার নিয়ে কথা বলা মানুষ যখন বলেন যে তিনি এখন মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেন, তখন বুঝতে হবে সমস্যাটা কতটা গভীর। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই দ্বিধার জন্য দায়ী কে? যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার জন্য কারা দায়ী?
২০২৪ সালের জুলাই মাসে যা ঘটেছে, সেটাকে যেভাবেই নাম দেওয়া হোক না কেন, মূল সত্যটা হলো একটা নির্বাচিত সরকারকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিদেশি অর্থায়ন, চরমপন্থী গোষ্ঠীর সহায়তা আর সামরিক সমর্থন মিলিয়ে যে ক্ষমতা দখল হয়েছে, সেটার পর থেকে মানবাধিকারের আসল চিত্রটা কী দাঁড়িয়েছে, সেটা নিয়ে কথা বলাটাই জরুরি।
মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার তথাকথিত সরকারের অধীনে গত কয়েক মাসে যা হয়েছে, তা মানবাধিকারের সব ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যেখানে আগে একটা আইনি কাঠামো ছিল, সেখানে এখন অনিশ্চয়তা। যেখানে মানুষের চলাফেরার স্বাধীনতা ছিল, সেখানে এখন ভয়। যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো এই দেশে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছে, তারা এখন প্রতিদিন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।
যে মানুষটা নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন দরিদ্র মানুষদের জন্য কাজ করার স্বীকৃতি হিসেবে, সেই মানুষই যখন অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোকে পদদলিত করার ব্যবস্থাকে মেনে নেন, তখন সেটা কেবল হতাশাজনক নয়, ভয়াবহভাবে বিপজ্জনকও। মাইক্রোক্রেডিট নিয়ে যার সুনাম, সেই মানুষের তত্ত্বাবধানে যখন দেশজুড়ে সহিংসতা চলে, সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি জ্বালানো হয়, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান লুটপাট হয়, তখন তার নৈতিক অবস্থানটা ঠিক কোথায় দাঁড়ায়?
সুলতানা কামাল ঠিকই বলেছেন, কোনো মানুষকে সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া গ্রেপ্তার করা যায় না। কিন্তু গত কয়েক মাসে কতজন মানুষকে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই তুলে নেওয়া হয়েছে? কতজন নিখোঁজ হয়েছেন? কতজনের পরিবার আজও জানে না তাদের প্রিয়জন কোথায়? আর এসব ঘটছে এমন একজন মানুষের নেতৃত্বে যিনি নিজেকে মানবাধিকারের পক্ষের মানুষ হিসেবে জাহির করে এসেছেন।
যে সংবিধানের কথা বলা হয়েছে, সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ আর ন্যায়বিচারের কথা, সেই সংবিধানকেই তো বাতিল করার চেষ্টা চলছে। একটা অবৈধ সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন সংবিধান আর কোনো মূল্য রাখে না। আর সেটাই এখন হচ্ছে। ইউনূস আর তার দলবল যে প্রশাসন চালাচ্ছে, সেটা কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসেনি। জনগণ তাদের ভোট দেয়নি, জনগণের কাছে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
এখানে আরেকটা বিষয় খুবই পরিষ্কার করা দরকার। বিদেশি শক্তির অর্থায়নে যখন কোনো পরিবর্তন আসে, তখন সেই পরিবর্তনের উদ্দেশ্য কখনোই দেশের মানুষের কল্যাণ হয় না। এই অর্থায়নের পেছনে থাকে নির্দিষ্ট স্বার্থ, নির্দিষ্ট এজেন্ডা। আর সেই এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য দরকার হয় একটা দুর্বল, নিয়ন্ত্রিত সরকার। ইউনূসের এই অসরকারটা ঠিক সেই ভূমিকাই পালন করছে। যেখানে দেশের মানুষের স্বার্থ থাকার কথা সবার আগে, সেখানে বিদেশি প্রভুদের ইচ্ছাই হয়ে উঠেছে মূল নির্ধারক।
ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলোর সহায়তা নিয়ে যে পরিবর্তন আসে, সেটা মানবাধিকারের জন্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে, সেটা তো আমরা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় দেখেছি। এই সংগঠনগুলোর কোনো লক্ষ্যই হলো না মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। তাদের লক্ষ্য ভয়ের রাজত্ব কায়েম করা, ভিন্নমতকে নিশ্চিহ্ন করা, সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করা। আর সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তারা সহিংসতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে যা ঘটেছে, সেটা ঠিক সেই ধরনের সহিংসতারই উদাহরণ।
সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছাড়া এই ধরনের ক্যু সফল হয় না। এটা ইতিহাসের শিক্ষা। কিন্তু সামরিক শক্তির সমর্থনে যে সরকার ক্ষমতায় আসে, সেটা কখনোই মানুষের অধিকারের পক্ষে থাকতে পারে না। কারণ তাদের ক্ষমতার ভিত্তিই হলো শক্তির প্রয়োগ, আইনের নয়। আর যেখানে শক্তিই প্রধান, সেখানে মানবাধিকার বলে কিছু থাকে না।
সুলতানা কামাল যখন বলেন মানুষ যেন ভয়ের সংস্কৃতিতে বাস না করে, তখন এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে ওঠে যে এই ভয়ের সংস্কৃতি কে তৈরি করছে? কারা এই পরিবেশ তৈরি করছে যেখানে মানুষ নিজের মত প্রকাশ করতে ভয় পায়, রাস্তায় বেরোতে ভয় পায়, নিজের পরিচয় নিয়ে চলতে ভয় পায়? এর জবাব খুব পরিষ্কার। ইউনূস আর তার অবৈধ সরকারের কর্মকাণ্ডই এই ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করছে।
জবাবদিহিতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু একটা অনির্বাচিত সরকারের জবাবদিহিতা থাকে কার কাছে? যারা জনগণের ভোটে আসেনি, যাদের কোনো গণতান্ত্রিক বৈধতা নেই, তারা কার কাছে জবাবদিহি করবে? বিদেশি অর্থদাতাদের কাছে? জঙ্গি সংগঠনগুলোর কাছে? সামরিক সমর্থকদের কাছে? নিশ্চয়ই জনগণের কাছে নয়। আর এখানেই আসল সমস্যা। একটা সরকার যখন জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়, তখন সে সরকার যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। মানবাধিকার তখন কেবল কাগজে-কলমে থাকা একটা ধারণা হয়ে দাঁড়ায়।
মাইক্রোফিন্যান্স আর ক্ষুদ্রঋণের জগতে ইউনূসের সুনাম ছিল। কিন্তু সেই সুনামের আড়ালে কী লুকিয়ে ছিল, সেটা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। যে মানুষ দরিদ্র মানুষদের উন্নয়নের কথা বলেছেন, সেই মানুষই যখন সাধারণ মানুষের ওপর সহিংসতাকে মেনে নেন, তখন তার আসল চেহারাটাই বেরিয়ে আসে। আর সেই চেহারাটা মোটেও সুন্দর নয়।
বাংলাদেশের মানুষ এই পরিস্থিতি চায়নি। তারা একটা নির্বাচিত সরকার চেয়েছিল, যে সরকার তাদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে। তারা চেয়েছিল একটা স্থিতিশীল পরিবেশ, যেখানে তারা নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারবে। তারা চায়নি যে বিদেশি শক্তি, জঙ্গি সংগঠন আর সামরিক বাহিনীর যোগসাজশে একটা অবৈধ সরকার তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সেটাই হয়েছে।
এখন যে পরিস্থিতি চলছে, সেটা টেকসই নয়। ইতিহাস বলে, জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থা কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মানুষ একসময় তার অধিকার ফিরে পায়। কিন্তু সেই ফিরে পাওয়ার পথটা যতই দীর্ঘ হয়, ততই মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। আর এই ভোগান্তির দায় কার? ইউনূস আর তার অসরকারের। যারা এই পুরো প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছে, তাদেরও।
মানবাধিকার শুধু বড় বড় কথা নয়, এটা প্রতিদিনের জীবনের সাথে জড়িত। একজন মানুষ যখন নিরাপদে ঘর থেকে বের হতে পারে না, যখন তার মতামত প্রকাশ করার স্বাধীনতা থাকে না, যখন তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তাকে হয়রানির শিকার হতে হয়, তখনই মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়। আর বর্তমান বাংলাদেশে এই লঙ্ঘন প্রতিদিন ঘটছে।
সুলতানা কামালের দ্বিধা আসলে দেশের সাধারণ মানুষের দ্বিধারই প্রতিফলন। কিন্তু এই দ্বিধা কাটানোর দায়িত্বও তো আছে। আর সেই দায়িত্ব শুরু হয় সত্যকে চিনতে পারা থেকে। বর্তমান সরকার অবৈধ, তাদের কোনো নৈতিক বা আইনি বৈধতা নেই। ইউনূস একজন ক্যু নেতা, গণতন্ত্রের রক্ষক নন। আর যত দিন এই সত্যকে স্বীকার করা না হবে, যত দিন এই অবৈধ ব্যবস্থা চলতে থাকবে, তত দিন মানবাধিকারের কথা বলাটাই শুধু দ্বিধার নয়, অর্থহীনও হয়ে পড়বে।

