ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়ায় বেলতলী বাজারে দোকানে বসে আছেন সোলায়মান সেলিম। দুই মেয়ে নিয়ে স্ত্রীর সাথে সংসার করছেন। কিন্তু ঢাকার আদালতে তিনি একজন মৃত মানুষ। ৩ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে গুলিতে নিহত। তার হত্যার দায়ে আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ ৪২ জনকে। বাস্তবতা হলো, সেলিমের ছেলে সন্তান নেই, আছে কিছু জমিজমা। তার ভাই ‘মোস্ত ডাকাত’ নামে পরিচিত মোস্তফা কামাল দশ বছর ধরে হত্যা মামলায় পলাতক। এই পলাতক আসামি জুলাইয়ের রক্তাক্ত দিনগুলোকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে ভাইকে ‘মেরে’ ফেলেছেন কাগজে-কলমে, যাতে পরে সত্যি সত্যি খুন করে সম্পত্তি দখল করা যায়।
এই একটা মামলা। দেশজুড়ে এরকম আরো কত হাজার মামলা হয়েছে তার হিসাব কেউ রাখছে না। কারণ যারা ক্ষমতায় এসেছেন তাদের কাছে হিসাবের চেয়ে প্রতিশোধ বড়, সত্যের চেয়ে বড় আখ্যান নির্মাণ। ড. ইউনুস আর তার তথাকথিত অন্তর্বর্তী সরকার গত দেড় বছর ধরে যে বাংলাদেশ নির্মাণ করছে, সেখানে একজন জীবিত মানুষকে মৃত বানিয়ে মামলা করা যায়, একজন পলাতক খুনি জমিজমা দখলের জন্য দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করতে পারে, আর পুরো বিচার ব্যবস্থা সেই মিথ্যার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে যতক্ষণ না গোয়েন্দা বিভাগ খুঁজে বের করে যে ‘লাশ’ আসলে বেঁচে আছে।
প্রশ্ন হলো, এরকম কতগুলো মামলায় গোয়েন্দা তদন্ত হবে? কতজন ‘নিহতের’ জীবিত থাকার প্রমাণ মিলবে? আর যেসব মামলায় সত্যি সত্যি মানুষ মারা গেছে, সেখানে কীভাবে নিশ্চিত হবেন যে আসামির তালিকা সঠিক? ইউনুস সরকার যে বিচার ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করেছে, তা হলো গণমাধ্যমে প্রচারিত আবেগ, রাস্তায় জমা হওয়া ভিড়ের চাপ আর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মিশ্রণ। এখানে তদন্ত, প্রমাণ, সাক্ষ্য-উপাত্ত সব কিছু গৌণ। মুখ্য হলো ন্যারেটিভ ধরে রাখা। যে ন্যারেটিভে শেখ হাসিনা আর আওয়ামী লীগ সব অপরাধের মূল, আর যারা রাস্তায় নেমেছিল তারা সবাই নিষ্পাপ স্বাধীনতাকামী।
কিন্তু সত্য একগুঁয়ে জিনিস। সেলিম বেঁচে আছেন বলে এই মামলার সত্য বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু যেসব মামলায় মৃত ব্যক্তি সত্যিই মৃত, সেখানে সত্য খুঁজে বের করার আগ্রহ কি এই সরকারের আছে? নাকি তারা শুধু চান মামলার সংখ্যা বাড়াতে, যাতে দেখানো যায় যে পূর্ববর্তী সরকার কতটা ‘নিপীড়ক’ ছিল? মজার ব্যাপার হলো, এই মামলাতেই আসামি করা হয়েছিল ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান কামাল, শামীম ওসমানের মতো নেতাদের। একজন মানুষও মরেনি, অথচ তাদের খুনি বানানো হয়েছিল। এটা কি বিচার ব্যবস্থা, নাকি প্রহসন?
ইউনুস সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে যে কাজটি সবচেয়ে নিষ্ঠার সাথে করেছে, তা হলো প্রাতিষ্ঠানিক ধ্বংসযজ্ঞ। বিচার বিভাগকে তারা পরিণত করেছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ারে। পুলিশ প্রশাসনকে বানিয়েছে দলীয় ক্যাডারদের সেবাদাস। প্রশাসনের সব স্তরে বসিয়ে দিয়েছেন নিজেদের লোকজন, যাদের যোগ্যতা নয়, আনুগত্যই মূল পরিচয়। আর এই পুরো প্রক্রিয়াকে বৈধতা দেওয়ার জন্য তারা ব্যবহার করছেন ‘সংস্কার’ আর ‘গণঅভ্যুত্থান’ শব্দগুলো। যেন শব্দের পুনরাবৃত্তিতে মিথ্যা সত্য হয়ে যাবে।
সেলিম এখন ভয়ে আছেন। তার নিজের কথায়, ভাইয়েরা তাকে আর তার দুই মেয়েকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। কারণ তিনি ‘মরে’ গেলে তার জমিজমা দখল করা সহজ হবে। কিন্তু আরো ভয়ের কথা হলো, এই পুরো প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র তার নিরাপত্তা দিতে পারবে কি? যে রাষ্ট্র একজন পলাতক খুনিকে মিথ্যা মামলা করার সুযোগ দিয়েছে, সেই রাষ্ট্র কি সেলিমের জীবন রক্ষা করবে? নাকি পরবর্তীতে যখন সত্যি সত্যি তাকে খুন করা হবে, তখন আবার শেখ হাসিনার নামে মামলা হবে?
ইউনুস সরকারের পুরো অস্তিত্ব দাঁড়িয়ে আছে একটা বড় মিথ্যার উপর। সেই মিথ্যা হলো, জুলাইয়ে যা হয়েছে তা একটা স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন ছিল। কিন্তু প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে যা প্রমাণ করছে যে এটা ছিল একটা সুপরিকল্পিত অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির প্রকল্প। বিদেশি অর্থায়ন, চরমপন্থী গোষ্ঠীর সংযোগ, সামরিক বাহিনীর একাংশের মদদ, এসব তথ্য আস্তে আস্তে প্রকাশ্যে আসছে। কিন্তু যারা এখন ক্ষমতায়, তাদের স্বার্থ এই সত্য চাপা দেওয়ায়। কারণ সত্য বেরিয়ে এলে তাদের বৈধতার ভিত্তি ভেঙে পড়বে।
এই সরকার গত দেড় বছরে কোনো নির্বাচন দেয়নি। অর্থনীতি তলানিতে ঠেকে গেছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন, আর তাদের একমাত্র কাজ হলো পুরনো সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা সাজানো। এটা কি শাসন, নাকি প্রতিশোধ? ইউনুস সাহেব দরিদ্রদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে নোবেল পেয়েছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে তিনি পুরো দেশকে ঋণী বানিয়ে ফেলছেন, আর সেই ঋণ শোধ হবে রক্তে আর অশ্রুতে।
মোস্তফা কামাল ওরফে ‘মোস্ত ডাকাত’ এখন পলাতক। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করার অভিযোগে ২১১ ধারায় মামলার অনুমতি চাওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এরকম আরো কত হাজার ‘মোস্ত ডাকাত’ এই দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে যারা জুলাইয়ের নামে নিজেদের ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, যে সরকার এই সব ডাকাতদের মদদ দিচ্ছে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে মিথ্যা মামলার পাহাড় তৈরি করছে, তারা নিজেরা কি ডাকাত নয়? শুধু তফাৎ এটুকুই যে তারা চুরি করছে একটা পুরো দেশের ভবিষ্যৎ, একটা জাতির আত্মসম্মান আর সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার।
সেলিম বেঁচে আছেন বলে এই একটা মিথ্যার মুখোশ খুলে গেছে। কিন্তু আরো কত হাজার মিথ্যা এখনো মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইউনুসের বাংলাদেশে, সেটা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। আর সবচেয়ে বড় মিথ্যা হলো এই যে, তারা দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে এসেছে। আসলে তারা এসেছে নিজেদের প্রভুদের সেবা করতে, দেশকে আরেকবার লুটপাট করতে, আর একটা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার অপরাধকে ‘বিপ্লব’ বলে চালিয়ে দিতে। ইতিহাস এই মিথ্যাগুলো মনে রাখবে। কারণ ইতিহাসের কাছে কোনো মিথ্যাই শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকে না।

