জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে একজন র্যাব সদস্যের স্ত্রী লিপি খাতুনকে নিজ ঘরে ঢুকে শ্বাসরোধে হত্যা করে পালিয়ে গেছে চোর। এই ঘটনা শুধু একটি চুরি বা খুনের ঘটনা নয়, এটি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এক ভয়াবহ প্রমানপত্র। যে মানুষটি দেশের মানুষের নিরাপত্তায় নিয়োজিত, তার পরিবারই যদি নিজের ঘরে নিরাপদ না থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা হবে সেটা কি ভেবে দেখার বিষয় নয়?
মহর উদ্দিন রাজধানীর র্যাব-২ এ কর্মরত। দেশের নিরাপত্তায় তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু তিনি যখন ডিউটিতে থাকেন, তখন তার স্ত্রী ও সন্তান কি নিরাপদ থাকতে পারছেন? লিপি খাতুনের মৃত্যু বলে দিচ্ছে, না, পারছেন না। একজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের পরিবারের এই পরিণতি যদি হয়, তাহলে যাদের কোনো পদমর্যাদা নেই, যাদের পরিচয় শুধু সাধারণ নাগরিক, তাদের কী নিরাপত্তা আছে এই দেশে?
পাঁচই আগস্টের পর থেকে এই দেশে যেন একটা অরাজকতার সময় চলছে। প্রতিদিন হত্যা, চুরি, ডাকাতি, অপহরণের খবর আসছে। কোথাও কোনো থেমে থাকা নেই। গত সোমবার ঢাকার মোহাম্মদপুরে লায়লা আফরোজ আর তার মেয়ে নাফিসাকে হত্যা করেছিল গৃহকর্মী। আজ জামালপুরে লিপি খাতুন। কাল হয়তো অন্য কোথাও, অন্য কোনো পরিবার। এভাবেই চলছে প্রতিদিন। মানুষ ঘরে নিরাপদ নয়, রাস্তায় নিরাপদ নয়, কর্মস্থলে নিরাপদ নয়।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে যে অস্থিরতা তৈরি করে একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হয়েছিল, তার পেছনে যারা ছিলেন, যারা সহায়তা করেছিলেন, যারা সমর্থন দিয়েছিলেন, তারা কি এই দেশটাকে এমন একটা জায়গায় দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন যেখানে মানুষের প্রাণ আর সম্পদের কোনো মূল্য নেই? নাকি এটাই ছিল তাদের পরিকল্পনা? জনগণকে বিভ্রান্ত করে, উসকানি দিয়ে, রাস্তায় নামিয়ে দেশে একটা গণবিস্ফোরণ ঘটানো, আর তারপর সেই বিশৃঙ্খলার সুযোগে ক্ষমতা দখল করে নেওয়া?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আর তার তথাকথিত অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে কি একটাও দিন গেছে যেদিন কোনো ভয়াবহ অপরাধের খবর আসেনি? প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে, সম্পদ লুট হচ্ছে, নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, কিন্তু সরকারের কী? কোনো দায় নেই, কোনো জবাবদিহিতা নেই। তারা ব্যস্ত আছেন নিজেদের ক্ষমতার পাকাপোক্ত আয়োজনে। তারা ব্যস্ত আছেন যারা তাদের ক্ষমতায় বসিয়েছে তাদের খুশি রাখতে।
একজন র্যাব সদস্যের স্ত্রীকে হত্যা করা হলো। পুলিশ বলছে, লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হবে। তারপর? তারপর কি এই হত্যাকারীকে ধরা হবে? শাস্তি হবে? নাকি আরও অনেক হত্যার মতো এটাও একটা ফাইলের পাতায় হারিয়ে যাবে? কারণ এই মুহূর্তে এই দেশে অপরাধীদের ধরার মতো, শাস্তি দেওয়ার মতো কোনো শক্তিশালী ব্যবস্থা নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো নিজেরাই দিশেহারা। তারা জানেন না কাকে আসল অপরাধী বলবেন, কাকে ছাড়তে হবে রাজনৈতিক চাপে।
লিপি খাতুনের মেয়ে সেদিন ঘরেই ছিল। সে দেখেছে তার মাকে হত্যা করা হচ্ছে। সেই শিশুর মনে কী দাগ পড়ল? সে কি আর কখনো নিরাপদ বোধ করবে? সে কি বিশ্বাস করবে যে এই দেশের আইন তার মায়ের হত্যাকারীকে শাস্তি দেবে? নাকি সে বড় হয়ে এটাই শিখবে যে এই দেশে প্রতিষ্ঠিত কোনো ব্যবস্থা নেই, ন্যায়বিচার একটা কাগুজে শব্দ মাত্র?
যে সরকার নিজেদের বৈধতা নিয়েই প্রশ্নের মুখে, তারা কীভাবে দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে? যে নেতৃত্ব ক্ষমতায় এসেছে বিদেশি অর্থায়ন আর সামরিক সমর্থনের জোরে, তারা কীভাবে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে? ইউনূস আর তার দল কি আদৌ জনগণের কল্যাণে আগ্রহী, নাকি তাদের একমাত্র লক্ষ্য ক্ষমতায় টিকে থাকা?
এই প্রশ্নগুলো এখন প্রতিটি বাংলাদেশীর মনে। লিপি খাতুনের মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের ট্র্যাজেডি নয়, এটি পুরো দেশের অবস্থার একটা প্রতিচ্ছবি। যে দেশে নিরাপত্তা রক্ষকদের পরিবারই নিরাপদ নয়, সে দেশে সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য কতটুকু? উত্তরটা খুবই স্পষ্ট, আর সেই উত্তর ভয়াবহ।

