ঢাকার বুকে প্রকৃতির শেষ আশ্রয়স্থল ধানমন্ডি লেক আজ মরণদশায়। প্রায় চল্লিশ মণ মরা মাছ তুলতে হয়েছে দূষিত পানি থেকে। লেকের পাড়ে আবর্জনার পাহাড়, পানিতে রাসায়নিক বর্জ্য, আর চারপাশে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কিন্তু যে প্রশাসন এই লেকের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছে, তাদের কাছ থেকে মিলছে শুধু অদ্ভুত সব পরামর্শ আর দায় এড়ানোর খেলা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী পরিচালকের পরামর্শটি শুনলে যে কারও মাথায় হাত যাবে। তিনি বলছেন, লেকের পাড়ে হকারদের উৎপাত কমাতে চাইলে জনগণকে সেখানে কিছু কিনতে হবে না। এই যুক্তি যদি মানা হয়, তাহলে শহরে চোর-ডাকাতের উৎপাত কমাতেও কি নাগরিকদের ঘরে তালা না দিতে বলা হবে? রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম কমাতে মানুষজনকে গাড়ি না চালাতে বলা হবে? যে প্রশাসনের কাজ হকার নিয়ন্ত্রণ করা, নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা, আইন প্রয়োগ করা, সেই প্রশাসন দায়িত্ব এড়িয়ে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। নাগরিকরা তো কর দেয় ঠিকমতো সেবা পাওয়ার জন্য, নিজেরা প্রশাসনের কাজ করার জন্য নয়।
গত বছরের জুলাই মাসে যে অরাজক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতায় এসেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার, তার পরিণতি এখন প্রতিটি প্রশাসনিক স্তরে দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক বৈধতা ছাড়া যারা ক্ষমতায় বসে আছেন, তাদের কাছে জবাবদিহিতার প্রশ্ন তোলার মতো কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধিও নেই। ফলে সিটি করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে যেমন খুশি তেমন। দায়িত্বহীনতাকে তারা বুদ্ধিমত্তা ভাবছেন, অদক্ষতাকে চালিয়ে দিচ্ছেন নীতি হিসেবে।
ধানমন্ডি সোসাইটির পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক তারেক রহমান স্পষ্ট বলেছেন যে তাদের হাতে দায়িত্ব দিলে তারা লেকের অবস্থা পাল্টে দিতে পারবেন। কিন্তু সিটি করপোরেশন সেই দায়িত্ব দিতেও রাজি নয়, আবার নিজেরা কাজ করতেও অক্ষম। এটা কোন ধরনের প্রশাসন যেখানে দায়িত্ব নিতে চায় না, দায়িত্ব দিতেও চায় না, শুধু চায় পদে বসে বেতন আর সুবিধা ভোগ করতে? জনগণের করের টাকায় চলা একটি প্রতিষ্ঠানের এই আচরণ নির্লজ্জতা ছাড়া আর কিছু বলার নেই।
লেকের পানিতে এখন মানুষ গোসল করছে, কাপড় ধুচ্ছে, আবর্জনা ফেলছে। জলজ প্রাণীদের জীবন হুমকিতে পড়েছে। চারপাশে খাবারের প্যাকেট, পলিথিন, চায়ের কাপের স্তূপ। আর এসব দেখার যেন কেউ নেই। যে প্রশাসনের কথা ছিল নিয়মিত টহল দেওয়া, লেক পরিষ্কার রাখা, আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তি দেওয়া, তারা বসে আছেন অফিসে আরামে। নাগরিকদের উপর দায় চাপিয়ে নিজেরা নির্বিকার থাকা এই প্রশাসনের নিত্যনৈমিত্তিক চরিত্রে পরিণত হয়েছে।
স্থপতি ইকবাল হাবিব ঠিকই বলেছেন যে পরিবেশবিরোধী প্রকল্প আর অপরিকল্পিত বাণিজ্যিকীকরণ লেককে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু এর দায়ও তো ওই সিটি করপোরেশনের, যারা নিয়মনীতি মানার তোয়াক্কা করে না, যাদের কাছে পরিবেশ সংরক্ষণের চেয়ে নিজেদের সুবিধা বড়। বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই জলাধার, যাকে বলা হয় নগরীর ফুসফুস, সেটাকে বাঁচানোর জন্য যে সমন্বিত পরিকল্পনা আর দৃঢ় পদক্ষেপ দরকার, তার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে যে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে দেশে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার প্রভাব পড়েছে প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে। বৈধতা আর জনগণের আস্থা ছাড়া কোনো সরকার যে সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, ধানমন্ডি লেকের অবস্থা তার প্রমাণ। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আর তার দলের কাছে যদি সত্যিই দেশের মানুষের কল্যাণ নিয়ে ভাবনা থাকত, তাহলে প্রশাসনিক এই অদক্ষতা আর দায়িত্বহীনতা এত প্রকটভাবে দেখা যেত না।
একটি শহরের পরিবেশ তার নাগরিকদের স্বাস্থ্য আর জীবনযাত্রার মানের সরাসরি প্রতিফলন। ধানমন্ডি লেক শুধু একটি জলাধার নয়, এটা ঢাকাবাসীর শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে জড়িত, জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল, মানসিক প্রশান্তির উৎস। কিন্তু যে সরকার জনগণের ভোট ছাড়াই ক্ষমতায় এসেছে, যাদের কাছে জবাবদিহিতার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তারা এসব বিষয়ে কতটা গুরুত্ব দেবে সেটা তো স্পষ্ট। লেক দূষিত হোক, মাছ মরুক, মানুষ অসুস্থ হোক, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। কারণ তাদের কাছে জনগণের কাছে জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের যে নির্বাহী পরিচালক নাগরিকদের উপর দায় চাপিয়ে নিজেদের অদক্ষতা ঢাকতে চাইছেন, তার অবস্থান এখনই পুনর্বিবেচনা করা উচিত। পাবলিক সার্ভিস মানে জনগণের সেবা করা, তাদের উপর দোষ চাপিয়ে দায় এড়ানো নয়। সিটি করপোরেশনের কাজ হকার নিয়ন্ত্রণ করা, নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো, আইন ভঙ্গকারীদের বিরুddhe ব্যবস্থা নেওয়া। জনগণ ট্যাক্স দেয় এসব সেবা পাওয়ার জন্য, নিজেরা সব সমস্যার সমাধান করার জন্য নয়।
এই অন্তর্বর্তী সরকারের যত দিন যাচ্ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে যে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। বৈধতা ছাড়া কোনো সরকার যে দীর্ঘমেয়াদে দেশের কল্যাণ করতে পারে না, ধানমন্ডি লেকের মতো ছোট ছোট বিষয়গুলোতেই তার প্রমাণ মিলছে প্রতিদিন। যে প্রশাসন একটি লেক পরিষ্কার রাখতে ব্যর্থ, তারা কীভাবে পুরো দেশকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করবে?

