দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে বিষয়টা চোখে পড়ে, তা হলো একটা অদ্ভুত বৈপরীত্য। একদিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে যে দলটা এই দেশের স্বাধীনতা এনেছে, মুক্তিযুদ্ধ করেছে, সেই আওয়ামী লীগকে রাজনীতি থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। এটা কেমন অন্তর্ভুক্তি? এটা তো বরং সবচেয়ে বড় বর্জন।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে যা ঘটেছে, তাকে কোনোভাবেই গণঅভ্যুত্থান বলা যায় না। একটা নির্বাচিত সরকারকে সুপরিকল্পিত উপায়ে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। এর পেছনে ছিল বিদেশি অর্থায়ন, জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় ভূমিকা আর একাংশের সামরিক সমর্থন। যে মুহাম্মদ ইউনূস এখন দেশ চালাচ্ছেন, তার কোনো নির্বাচনী বৈধতা নেই। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তার বিতর্কিত অতীত সবার জানা। একজন সুদের কারবারি কীভাবে দেশের প্রধান উপদেষ্টা হলেন, এই প্রশ্ন তো থেকেই যায়।
এই তথাকথিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যা করছে, তা দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায় তাদের লক্ষ্য কী। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর নির্বিচার হামলা, মামলা, হয়রানি চলছে। দলের অফিস দখল হয়েছে, ভাঙচুর হয়েছে। যারা আওয়ামী লীগ করেছেন বা সমর্থন দিয়েছেন, তাদের জীবন এখন অনিরাপদ। এটা কি ন্যায়বিচার, নাকি রাজনৈতিক প্রতিশোধ?
দেশের সবচেয়ে পুরনো, সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন থেকে বাদ দিয়ে কীভাবে গণতন্ত্র হবে? যে দলের নেতৃত্বে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে, যে দলের কোটি কোটি সমর্থক আছে, তাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে কোন ধরনের নির্বাচন হতে পারে? এটা তো নির্বাচন নয়, একতরফা প্রহসন মাত্র।
যারা এখন ক্ষমতায় আছেন, তারা মুখে মুখে ন্যায়বিচার আর জবাবদিহির কথা বলছেন। কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? শেখ হাসিনা সরকারের আমলে যদি কোনো অপরাধ হয়ে থাকে, তার বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত। কিন্তু সেই বিচার হতে হবে আইনের মাধ্যমে, আদালতের মাধ্যমে। গণপিটুনি, মব জাস্টিস বা রাজনৈতিক নিপীড়নের মাধ্যমে নয়। যারা আসলেই অপরাধী, তাদের শাস্তি হোক। কিন্তু একটা পুরো দলকে, তাদের সব সমর্থককে কেন দায়ী করা হচ্ছে?
এই যে ন্যাশনাল জাস্টিস অ্যান্ড ট্রানজিশন চার্টারের কথা বলা হচ্ছে, এটা দেখতে ভালো শোনায়। কিন্তু এর বাস্তবায়ন কোথায়? দক্ষিণ আফ্রিকা বা চিলির উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওই দেশগুলোতে সব পক্ষকেই টেবিলে বসতে দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশে তো উল্টো ঘটছে। একটা পক্ষকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চলছে। এটা কোন ধরনের ন্যায়বিচার?
আওয়ামী লীগের মধ্যে অবশ্যই এমন মানুষ আছেন যারা কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তারা দলটাকে সমর্থন করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কারণে, দেশের উন্নয়নের কারণে, ধর্মনিরপেক্ষতার কারণে। এই মানুষগুলোকে কেন রাজনীতি থেকে দূরে রাখা হবে? তারা কি নাগরিক নন? তাদের কি ভোটের অধিকার নেই?
এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। একটা বিশাল জনগোষ্ঠীকে যদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়, তাহলে সেই শূন্যতা পূরণ হবে কীভাবে? ইতিহাস বলে, এই ধরনের বর্জন দীর্ঘমেয়াদে অস্থিরতা তৈরি করে। কাশ্মীর, পাকিস্তান, সুদান এর প্রমাণ।
এই মুহূর্তে যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা হয়তো ভাবছেন তাদের পেছনে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সমর্থন আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতি এতটা সরল নয়। আজ যারা ব্যবহৃত হচ্ছেন, কাল তাদেরই বাদ দেওয়া হতে পারে। আফগানিস্তানের মুজাহিদিনদের কথা মনে করুন। একসময় তারা স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন পশ্চিমাদের চোখে, পরে তারাই সন্ত্রাসী হয়ে গেলেন। ভূরাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলে কিছু নেই, আছে শুধু স্বার্থ।
পশ্চিমা শক্তিগুলো কখনোই আওয়ামী লীগের মতো একটা বড়, পুরনো, সেক্যুলার দলকে পুরোপুরি বাদ দেবে না। কারণ তাদের নিজেদের স্বার্থেই এই ধরনের একটা শক্তি দরকার হতে পারে ভবিষ্যতে। যখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বেশি শক্তিশালী হয়ে যাবে, তখন ভারসাম্য রক্ষার জন্য আওয়ামী লীগের মতো দলই তাদের কাজে লাগবে। এটা ভূরাজনীতির বাস্তবতা।
এখন যে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে, তাতে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে হলে সেটা হবে একটা অসম্পূর্ণ, অগ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের জনগণ এটা মেনে নেবে না। কারণ তারা জানেন, আওয়ামী লীগ মানে শুধু একটা রাজনৈতিক দল নয়, এটা এই দেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একাত্তরের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সবকিছুর সঙ্গে এই দলটা জড়িত।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই ধরনের একতরফা নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেবে না। একটা বৈধ, অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ জরুরি। যদি দেশের সবচেয়ে বড় দলটাই নির্বাচনে না থাকে, তাহলে সেই নির্বাচনের ফলাফল কে মানবে? এটা হবে আরেকটা বিতর্কিত সরকার, যার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে শুরু থেকেই।
ইউনূস ও তার দল যা করছে, তা দেশকে আরও বিভক্ত করছে। তারা যে ভাষা ব্যবহার করছেন, যেভাবে একটা পক্ষকে শত্রু বানিয়ে ফেলছেন, তাতে সমাজে বিদ্বেষ ও অস্থিরতা বাড়ছে। এই বিভাজন দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর হবে।
যারা এখন ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের কথা বলছেন, তাদের মনে রাখা উচিত, গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, কিন্তু সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষাও। গণতন্ত্র মানে বিজয়ীর একচেটিয়া ক্ষমতা নয়, সবার জন্য জায়গা থাকা। আর যদি বাংলাদেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র চান, তাহলে আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে থাকতে দিতেই হবে।
এই যে ট্যাগিং সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, যেখানে যেকোনো ভিন্নমতকে দেশদ্রোহিতা বলে চিহ্নিত করা হয়, এটা ভয়ংকর। এভাবে চললে দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না। সবাই ভয়ে চুপ করে থাকবে। আর সেটা কোনো গণতন্ত্র নয়, সেটা একনায়কতন্ত্র।
বাংলাদেশ একটা জটিল ভূরাজনৈতিক অবস্থানে আছে। ভারত, চীন, আমেরিকা সবার দৃষ্টি এই অঞ্চলে। এই পরিস্থিতিতে দেশের ভেতরে অস্থিরতা তৈরি করা, একটা বড় অংশকে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এতে দেশ দুর্বল হবে, বাইরের শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ বাড়বে।
আওয়ামী লীগকে ছাড়া কোনো নির্বাচন হতে পারে না, এটা শুধু রাজনৈতিক বাস্তবতা নয়, এটা ইতিহাসের দাবি। যে দল এই দেশকে স্বাধীন করেছে, যে দলের নেতার নামে এই দেশের নাম, সেই দলকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। এটা করতে গেলে দেশের ভিত্তিমূলেই আঘাত হানা হবে।
তাই এই অন্তর্ভুক্তিহীন নির্বাচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলেও তা হবে একটা ফাঁপা প্রক্রিয়া, যার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। না দেশের মানুষের কাছে, না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে। আর সেই নির্বাচন থেকে যে সরকার আসবে, তা হবে আরেকটা বিতর্কিত, দুর্বল সরকার।
বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র চায়, কিন্তু আসল গণতন্ত্র। যেখানে সবার কথা শোনা হবে, সবার ভোটের মূল্য থাকবে। এই ভণ্ডামি আর প্রহসনের নাম গণতন্ত্র নয়।

