নাটোরের লালপুরে পদ্মা নদীর চরাঞ্চলে এখন যেটা চলছে, সেটাকে নৈরাজ্য বললে ভুল হবে। এটা আসলে একটা সুসংগঠিত সন্ত্রাসী শাসনব্যবস্থা। যেখানে রাষ্ট্রের বদলে কাঁকন বাহিনী, মণ্ডল বাহিনী, টুকু বাহিনীরা আইন, আদালত, প্রশাসন সব। আর মুহাম্মদ ইউনূসের তথাকথিত অন্তর্বর্তী সরকার? তারা বোধহয় এখনও বুঝে উঠতে পারছে না যে দেশ চালানো মাইক্রোক্রেডিট কোম্পানি চালানোর মতো সহজ নয়।
২০২৪ এর জুলাইয়ের দাঙ্গার পর যখন ইউনূস ক্ষমতা দখল করলেন, তখন তো বলা হয়েছিল ক্যু পরবর্তী দেশে এবার আইনের শাসন ফিরবে, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। কিন্তু বাস্তবে কী দেখছি? পদ্মার চরে গত অক্টোবরে তিনজন খুন হলো। তার আগে জুন-জুলাই মাসে চারটা গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। নভেম্বরে একটা বড় অভিযান চালিয়ে ৬৭ জনকে ধরা হলো। কিন্তু এখনও ওই এলাকার মাঝিরা ভয়ে পদ্মায় নৌকা নিয়ে যেতে চায় না। এর মানে কি দাঁড়ালো? মানে হলো, শেকড় আগের মতোই আছে, শুধু ডালপালা একটু ছাঁটা হয়েছে।
যে রোকনুজ্জামান কাঁকন এই সন্ত্রাসী সাম্রাজ্যের মূল নায়ক, তার তো শতাধিক অস্ত্রধারী লোকবল আছে। ট্রলার আছে, স্পিডবোট আছে। একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কীভাবে এত বড় সশস্ত্র বাহিনী দাঁড় করাল? টাকা এলো কোথা থেকে? অস্ত্র এলো কোথা থেকে? এগুলো তো আকাশ থেকে পড়ে না। পুলিশের একজন কর্মকর্তা নিজেই স্বীকার করেছেন যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের নাম তদন্ত করা হচ্ছে, যারা ঘুষ নিয়েছে। তদন্ত চলছে মানে কী? এখনও তাদের চাকরিতে বহাল আছে? এখনও তারা পদ্মার চরের দায়িত্বে আছে? এই যে নরম হাতে অপরাধীদের সামলানোর নীতি, এটা কি ইউনূস সরকারের নতুন কায়দা?
আরও মজার ব্যাপার হলো, গ্রেফতারকৃতরা নিজেরাই বলছে যে রাজনৈতিক দলের নেতারা জড়িত। তো কোন দলের কোন নেতারা? নাম কেন প্রকাশ করা হচ্ছে না? কারণ কি এই যে, ইউনূস সরকারের সমর্থক বাহিনীর মধ্যে এই লোকগুলো আছে? জুলাইয়ের তথাকথিত বিপ্লবের নামে যারা ক্ষমতায় এসেছে, তাদের নিজেদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস আছে? নাকি তাদের কাছে রাজনৈতিক সুবিধা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সাধারণ মানুষের জীবন কম গুরুত্বপূর্ণ?
পদ্মার চরের কৃষকরা যে ভাষায় কথা বলছেন, সেটা শুনলে বোঝা যায় তাদের অসহায়ত্ব কতটা গভীর। সিদ্দিক আলী বলছেন, এক হাজার বিঘা জমি ভেঙে গেছে কয়েক দিনে। তার জমি যাচ্ছে, বাড়ি যাচ্ছে, কিন্তু নতুন জমি কেনার টাকা নেই। আশরাফুল বলছেন, এভাবে চললে আবাদি মাঠ থাকবে না। মতিউর রহমান, জসিম উদ্দিন, সবাই একই কথা বলছেন। মোল্লা ট্রেডার্স নির্ধারিত সীমার বাইরে গিয়ে বালু তুলছে, আর সাধারণ মানুষের জীবন ধ্বংস হচ্ছে। কৃষি কর্মকর্তা প্রীতম কুমার হোড় বলছেন, এভাবে চললে লালপুর শহর পর্যন্ত হুমকিতে পড়বে। তো ইউনূস সরকার কি অপেক্ষা করছে যে পুরো শহর নদীগর্ভে বিলীন হোক, তারপর নোটিশ নেবে?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চৌধুরী এম সারোয়ার জাহান একদম পরিষ্কার করে বলেছেন, এটা বালু দস্যুতা। শুধু স্থানীয় মানুষ নয়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আর হার্ডিঞ্জ ব্রিজও হুমকিতে আছে। একটা দেশের একমাত্র পারমাণবিক স্থাপনা, যেটা তৈরি করতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে, সেটা হুমকিতে। শতবর্ষী ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, যেটা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সেটা হুমকিতে। আর ইউনূস সরকার কী করছে? জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন বলছেন, নিয়ম মেনে বালু তুলতে হবে। এই যদি হয় সমাধান, তাহলে তো সমস্যা আরও ৫০ বছর চলবে।
আসল কথা হলো, ইউনূস সরকারের কাছে দেশ চালানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। তাদের কাছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কোনো দক্ষতা নেই। তারা বসেছে আন্তর্জাতিক মদদদাতাদের তোষামোদি করতে, রিপোর্ট লিখতে, বক্তৃতা দিতে। কিন্তু মাঠে যেটা দরকার, সেটা হলো দৃঢ় পদক্ষেপ। পদ্মার চরের সন্ত্রাসীদের শেকড় উপড়ে ফেলা দরকার, শুধু ডালপালা কাটলে হবে না। যেসব পুলিশ সদস্য ঘুষ নিয়েছে, তাদের অবিলম্বে চাকরিচ্যুত করতে হবে, জেলে পাঠাতে হবে। যেসব রাজনৈতিক নেতা জড়িত, তাদের নাম প্রকাশ করতে হবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে বালু তুলছে, তাদের লাইসেন্স বাতিল করতে হবে।
কিন্তু ইউনূস সরকার এগুলো করবে কেন? তারা যে নিজেরাই এসেছে অবৈধভাবে। একটা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে, হাজার হাজার মানুষের রক্তের বিনিময়ে ক্ষমতায় বসেছে। যে সরকার নিজেই বৈধতার সংকটে ভুগছে, তারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে কীভাবে? যে সরকার এসেছে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে, তারা শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করবে কীভাবে? সত্য হলো, পদ্মার চরে যে নৈরাজ্য চলছে, সেটা আসলে ইউনূস সরকারের শাসনব্যবস্থারই প্রতিচ্ছবি। উপরে যেমন, নিচেও তেমন।

