বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন যে, একটি ক্ষুদ্র, স্বার্থান্বেষী, অনির্বাচিত রাজনীতিকরা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ দখল করেছে, যারা আদালত ব্যবহার করে তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দিচ্ছে। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছেন, “মোদি এবং ভারতের জনগণের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, যারা আমার সংকটের সময় আমাকে সমর্থন দিয়েছেন।”
একটি ইমেল সাক্ষাৎকারে ভারতের বার্তা সংস্থা আইএনএসকে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা নিজের বিরুদ্ধে দেওয়া রায়কে ‘পক্ষপাতদুষ্ট এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং একই সঙ্গে নির্বাচন সংস্কার, বিদেশি হস্তক্ষেপ ও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
আইএএনএস: বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী মোদির ভূমিকা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শেখ হাসিনা: ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী ও অংশীদার। আমি প্রধানমন্ত্রী মোদির সমর্থন এবং আমাদের দুই দেশের দীর্ঘদিনের সম্পর্ককে মূল্য দিই। ব্যক্তিগত ও কূটনৈতিক—দুই পর্যায়েই বিপদের সময় আমাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। ভারতের সঙ্গে দৃঢ় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাংলাদেশের স্বার্থে, এবং এটি অঞ্চলে স্থায়ী স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারে।
আইএএনএস: সংকটের সময় প্রধানমন্ত্রী মোদি আপনাকে কীভাবে সহায়তা করেছেন?
শেখ হাসিনা: ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনা এবং সম্পর্ক নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না; তবে আমি এটুকু বলব যে ভারতের জনগণ আমাকে যে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
আইএএনএস: আপনি আইসিটির রায়কে “পক্ষপাতদুষ্ট এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বলেছেন। কেন?
শেখ হাসিনা: এই অভিযোগগুলো আনা হয়েছে একটি ক্যাঙ্গারু কোর্ট-এর মাধ্যমে, যা আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের একটি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তারা অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা দখল করেছে। স্বার্থপর ও অনির্বাচিত কিছু রাজনীতিবিদ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ দখল করে আদালতকে ব্যবহার করছে আমাকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সরিয়ে দিতে।
বিশ্বের বহু সম্মানিত ও নিরপেক্ষ আইনজ্ঞ একই মত প্রকাশ করেছেন। আমাকে বিচার চলাকালে যথাযথ আইনি প্রতিনিধি দেওয়া হয়নি, এমনকি আমার বিরুদ্ধে উপস্থাপিত দুর্বল ও অপ্রত্যয়কর প্রমাণগুলো চ্যালেঞ্জ করার সুযোগও পাইনি। পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল একটি সাজানো বিচারিক প্রহসন, যার উদ্দেশ্য ছিল পূর্বনির্ধারিত রায় ঘোষণা করা।
আইএএনএস: আপনি কি বিশ্বাস করেন যে মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বিদেশী শক্তির সঙ্গে কাজ করছে?
শেখ হাসিনা: আমার বেশি অনুমান করার ইচ্ছা নেই, তবে আমাদের জাতীয় বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপের কিছু উদ্বেগজনক চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। আমি বারবার বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছি, যা অভ্যন্তরীণ বিভাজনকে কাজে লাগায়। যে কোনো বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ স্বচ্ছভাবে তদন্ত করা উচিত। বাংলাদেশের সমস্যাগুলো তার নিজের প্রতিষ্ঠান এবং সার্বভৌম ইচ্ছার মাধ্যমে সমাধান করার স্বাধীনতা থাকতে হবে, বাইরের প্রভাবের মাধ্যমে নয়।
আইএএনএস: আপনি কি বিশ্বাস করেন যে বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন ইতিমধ্যেই বর্তমান সরকার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে?
শেখ হাসিনা: স্বাধীন, ন্যায্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই বৈধ সরকারের ভিত্তি। যদি অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির পরিবর্তে ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে, তাহলে তা আমাদের গণতন্ত্রের উপর আঘাত হবে। আমি সকল দল ও প্রার্থীকে ভয়ভীতি ছাড়া প্রচারণা করার নিশ্চয়তার আহ্বান জানাচ্ছি।
তবে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সব এই প্রস্তাবনাকে অকার্যকর করে দেয়, কারণ আমাদের কোটি কোটি সমর্থক সম্ভবত ঘরে থাকবেন। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দলকে আপনি নিষিদ্ধ করতে পারেন না এবং সেটিকে স্বাধীন ও ন্যায্য নির্বাচন হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন না।
আইএএনএস: আপনার দল নির্বাচনে অংশ নেবে নাকি বর্জন করবে?
শেখ হাসিনা: বর্তমান অবস্থায়, আমাদের দলকে আগামী বছরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটি কোনো বর্জন নয়; এটি কোটি কোটি ভোটারের ভোটাধিকার হরণ। যদি নির্বাচনের সময়ও এ অবস্থা থাকে, তবে আমাদের সমর্থকরা সম্ভবত কোনো ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিবর্তে ঘরে থাকবেন।
আইএএনএস: কিছু ব্যক্তির দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক নিপীড়ন কি সব সীমা অতিক্রম করেছে?
শেখ হাসিনা: ধর্ম বা রাজনৈতিক কারণে কোনো নিপীড়ন গ্রহণযোগ্য নয়। আমি সকল রূপের সহিংসতা ও নিপীড়ন প্রত্যাখ্যান করি। আমার নেতৃত্বে আমরা নাগরিক অধিকার রক্ষা করে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চেষ্টা করেছি। যদি কোনো অপব্যবহার ঘটে থাকে, তবে তা তদন্ত করা উচিত এবং সঠিক, ন্যায়সংগত আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তিগত দায়িত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সাধারণ অনুমান কোনো রকম প্রাসঙ্গিক, নিরপেক্ষ তদন্তের বিকল্প হতে পারে না।
আইএএনএস: খালেদা জিয়া গুরুতর অবস্থায় আছেন, এবং বাংলাদেশ তাকে হাসপাতালে সুরক্ষার জন্য একটি বাহিনী মোতায়েন করেছে। আপনি তাকে কীভাবে স্মরণ করতে চান?
শেখ হাসিনা: খালেদা জিয়ার অসুস্থতার খবর পেয়ে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, এবং আমি প্রার্থনা করব যেন তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।
আইএএনএস: আপনার ভাগ্নি, যুক্তরাজ্যের আইনপ্রণেতা টিউলিপ সিদ্দিক, একটি জমি সংক্রান্ত মামলায় অনুপস্থিত অবস্থায় দণ্ডিত হয়েছেন। আপনার প্রতিক্রিয়া?
শেখ হাসিনা: অনুপস্থিত অবস্থায় বিচার এবং একটি ব্রিটিশ আইনপ্রণেতাকে দণ্ডিত করা যথাযথ প্রক্রিয়া ও ন্যায্যতার ব্যাপারে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। আমার পরিবারের সদস্যরা সবসময় কোনো ভুল কাজের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আমি বিশ্বাস করি যে ন্যায়বিচার অবশ্যই উন্মুক্ত, স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী হওয়া উচিত। ইউনূস এই মামলাগুলো ব্যবহার করছেন নিজের প্রশাসনিক ব্যর্থতা ঢাকতে এবং একটি রাজনৈতিক দলকে দমন করতে, যা স্বাধীনতার পর থেকে নয়বার নির্বাচিত হয়েছে। এই রায় কেবল ইউনূস এবং তার বিচ্ছিন্ন, সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বার্থে কাজ করে।
এটি বাংলাদেশের স্বার্থে কোনোভাবে উপকারী নয়, বিশেষ করে কারণ এটি যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও উন্নয়ন সহযোগী। এই প্রক্রিয়াগুলো পরিচালনার ধরণ বাংলাদেশের প্রতি আস্থা ক্ষুণ্ণ করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ সৃষ্টি করবে।
আইএএনএস: বাংলাদেশ গুরুতর অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আপনার মতে, এর কারণ কী?
শেখ হাসিনা: বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী মৌলিক কাঠামো শক্তিশালী আছে, তবে স্বল্পমেয়াদী অশান্তি স্পষ্টভাবে প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগকারীর আস্থা এবং রিজার্ভে প্রভাব ফেলেছে। আমার কঠোর সমালোচকরাও স্বীকার করবেন যে আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবিশ্বাস্যভাবে এগিয়ে নিয়েছি, যার ওপর আমি অত্যন্ত গর্বিত। স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, বিনিয়োগকারীর আস্থা পুনর্নির্মাণ করা এবং বিশ্বাসযোগ্য আর্থিক ও কাঠামোগত সংস্কারের দ্রুত বাস্তবায়ন করা এখন অগ্রাধিকার হওয়া উচিত, যাতে পূর্বের সকল অগ্রগতি নষ্ট না হয়। আইএমএফ এবং স্বাধীন বিশ্লেষকরা ইতিমধ্যেই হ্রাসপ্রাপ্ত প্রবৃদ্ধি এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি তুলে ধরেছেন, যা অনিবার্যভাবে দেশের সবচেয়ে দুর্বলদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
আইএএনএস: আপনার পদত্যাগের পর পাকিস্তান কি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান এবং গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ দখল করছে?
শেখ হাসিনা: বাংলাদেশের জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্ক থাকা জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন, তবে এটি পরিমাপযুক্ত এবং ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া উচিত। আমরা এই অনির্বাচিত সরকারকে পাকিস্তানের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে তাড়াহুড়ো করতে দিতে পারি না। বাংলাদেশকে তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে এবং অঞ্চলে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মনে রাখতে হবে, যাতে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
আইএএনএস: এমন গুঞ্জন রয়েছে যে আপনার অপসারণের পেছনে একটি বিদেশি শক্তি—বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র—জড়িত ছিল। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
শেখ হাসিনা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যভাবে কোনো হস্তক্ষেপ অস্বীকার করেছে, এবং এ পর্যন্ত এমন কোনো স্পষ্ট প্রমাণ প্রকাশ করা হয়নি যা তাদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে। প্রমাণহীন অভিযোগ স্থিতিশীলতা, জবাবদিহিতা এবং জাতীয় ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রকৃত কাজ থেকে মনোযোগ বিভ্রান্ত করতে পারে।

