বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গতকাল (৭ ডিসেম্বর) আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের দুই কন্যা—লেয়লা আলিয়েভা ও আরজু আলিয়েভা—সাক্ষাৎ করেছেন। কেউ কেউ এটিকে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারের উদ্যোগ হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও, অভিযোগ উঠেছে যে এর আড়ালে গ্রামীণ টেলিকমের বিপুল সম্পদ বিদেশে পাচার ও বিক্রির গোপন পরিকল্পনা রয়েছে। সমালোচকদের দাবি, এই সাক্ষাৎ কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়; বরং প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ ‘ক্লিন’ করে বাইরে সরিয়ে নেওয়ার কৌশল নির্ধারণের একটি সূচনা।
উল্লেখযোগ্য হলো—বাংলাদেশে আজারবাইজানের কোনো স্থায়ী দূতাবাস নেই; দেশটির রাষ্ট্রদূত ভারতের নয়াদিল্লিতে অবস্থান করেন এবং নন-রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দুই দেশের মধ্যে বড় কোনো অর্থনৈতিক সম্পর্কও নেই। তাই এ পরিস্থিতিতে আলিয়েভা কন্যাদের ঢাকা সফর এবং ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক ঘিরে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগকারী মহলের মতে, এটি গ্রামীণ টেলিকমের শেয়ার বিক্রি ও লভ্যাংশ পাচারের জন্য একটি ‘ব্রিজ’ তৈরির উদ্যোগ।
আলিয়েভা কন্যাদের ‘দুর্নীতির সাম্রাজ্য’ ও অফশোর সম্পদ
লেয়লা ও আরজু আলিয়েভা আজারবাইজানের অন্যতম শীর্ষ মোবাইল অপারেটর আজারসেল (আজারফোন)-এর পর্দার আড়ালের মালিক। ২০১১ সালের এক তদন্তে উঠে আসে, তারা তিনটি পানামিয়ান অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে আজারফোনের ৭২ শতাংশ শেয়ার নিয়ন্ত্রণ করতেন। এসব কোম্পানির লভ্যাংশ অফশোর অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়ে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে লন্ডনের অচল সম্পত্তি, সোনার খনি ও অন্যান্য বিনিয়োগে ব্যবহৃত হয়।
২০১৬ সালের পানামা পেপার্সে তাদের নাম প্রকাশিত হয় ‘কিংসভিউ ডেভেলপমেন্টস’ ও ‘এক্সালটেশন লিমিটেড’ নামে দুটি ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জভিত্তিক কোম্পানির মালিক হিসেবে, যাদের মাধ্যমে লন্ডনে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ উঠে। ২০২১ সালের প্যান্ডোরা পেপার্সেও একই ধরনের অফশোর দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ ও কর ফাঁকির অভিযোগ পুনরায় প্রকাশিত হয়। এইভাবে আলিয়েভ পরিবার আজারবাইজানের পেট্রোস্টেট অর্থনীতি থেকে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
গ্রামীণ টেলিকমের বিপুল সম্পদ
অন্যদিকে, গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থ দিয়ে গঠিত গ্রামীণ টেলিকম বাংলাদেশের শীর্ষ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের ৩৪.২ শতাংশ শেয়ারের মালিক। ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের কল্যাণে এই লাইসেন্স প্রদান করে, যাতে লভ্যাংশ থেকে ব্যাংকের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বর্তমানে এই বিপুল সম্পদের একক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ড. ইউনূসের হাতে এমন অভিযোগ বহুদিনের।
২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রামীণফোনের বাজারমূল্য ৩৭৫.৬৫ বিলিয়ন টাকা (প্রায় ৩.২৭ বিলিয়ন ডলার)। এর মধ্যে গ্রামীণ টেলিকমের অংশের মূল্য প্রায় ১২৮ বিলিয়ন টাকা (১.১২ বিলিয়ন ডলার)। গ্রামীণফোনের লভ্যাংশ হিসেবে ২০২৫ ইন্টারিম ১১০% (১১ টাকা প্রতি শেয়ার), ২০২৪ ফাইনাল ১৭০% (১১ টাকা), ইন্টারিম ১৬০% (১৬ টাকা) এবং ২০২৩ ফাইনাল ১২৫% (১২.৫ টাকা) অন্তর্ভুক্ত। লভ্যাংশ, বিনিয়োগ ও শেয়ারমূল্য মিলিয়ে গ্রামীণ টেলিকমের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা যা সমালোচকদের ভাষায় ইউনূসের ‘পার্সোনাল ইম্পায়ার’।
সাক্ষাতের উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন প্রশ্ন
সূত্রমতে, এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য গ্রামীণ টেলিকমের বিক্রি ও সম্পদ বিদেশে স্থানান্তরের কৌশল নির্ধারণ। অভিযোগকারীদের দাবি অফশোর লেনদেনে আলিয়েভা কন্যাদের বিস্তৃত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা ছাড়ার আগেই ড. ইউনূস এই সম্পদ ‘সুরক্ষিত’ করার পথ খুঁজছেন। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক বিক্রির ঘোষণা দেওয়া হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, এই বৈঠককে ‘টেলিকম সেক্টরে ফরেন ওনারশিপ ক্যাপস’-এর সাম্প্রতিক আলোচনার প্রেক্ষিতে দেখা উচিত যা গ্রামীণফোনের মতো বড় কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তনের পথ তৈরি করতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এমন অস্বচ্ছ লেনদেনের অভিযোগ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। বিশ্লেষকদের প্রশ্ন গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা, যাদের কল্যাণের কথা বলে এই সম্পদ গড়ে উঠেছিল, তারা কি প্রকৃত সুবিধা পাবেন? নাকি এটি আরেকটি ‘ফ্যামিলি এম্পায়ার’ গড়ার সূচনা? এই ঘটনার স্বচ্ছ তদন্তের দাবিও জোরালো হচ্ছে।

