জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিসের ( OHCHR ) একটি তথ্য অনুসন্ধানী দল ( Fact Finding Team ) ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ থেকে সীমিতভাবে সরেজমিনে পরিদর্শন করে ২০২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের তথাকথিত আন্দোলনের উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বাংলাদেশের ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হয়। যেহেতু বাংলাদেশে মিডিয়া সমূহে সেন্সরশিপ আরোপিত আছে ( সেটা সরকার কর্তৃক আরোপিত হোক বা অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কায় হোক আর চলমান Mobocrisy-এর প্রভাবে আক্রমণের শিকার হওয়ার ভয়ে ভীত হয়ে হোক ), সেহেতু প্রতিবেদনের সেই অংশ বিশেষই প্রকাশিত হয়েছে যা শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে যায় ।
OHCHR -এর রিপোর্টের ২২৭ নং অনুচ্ছেদে তো তারই প্রতিফলন দেখা যায় – “ Since 5 August, many journalists and other civil society observers have perceived a climate of reverse intimidation, where journalists and media outlets are cautious about reporting anything that could be seen as favourable to the Awami League or critical of its political opposition”. ৫ আগষ্টের পর থেকে অনেক সাংবাদিক এবং অন্যান্য সুশীল সমাজের পর্যবেক্ষকরা বিপরীত ভীতির পরিবেশ অনুভব করছেন, যেখানে সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমগুলো আওয়ামী লীগের পক্ষে অনুকূল বা এর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলের সমালোচনামূলক বলে মনে হতে পারে এমন যে কোন কিছু রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকছে।
তাই OHCHR -এর প্রতিবেদনে আরও কি কি আছে সত্য উম্মোচনের স্বার্থে সেটা বাংলাদেশের জনগণের জানা প্রয়োজন । যেহেতু যে সব বিষয়সমূহ তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যায় সেসব বিষয় মিডিয়া ইতিমধ্যে ছাপিয়েছে, সে সবের উপর কম প্রাধান্য দিয়ে বাকি বিষয়ের উপর আলোকপাত করা শ্রেয়।
এ নাশকতায় প্রচুর প্রানহানির ঘটনা ঘটেছে। তবে এ সমস্ত প্রানহানি যে শুধু রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তিসমুহ দ্বারা ঘটেছে এমন নয়, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলও এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল বলে OHCHR- এর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধরনের প্রানহানির ঘটনার বিশ্লেষণ তৃতীয় বিশ্বের দেশ সমূহের পরিস্থিতির আলোকে করলে ভাল হয়। এটা স্মরণে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশে ১৯৯৬ সনের ১৫ ফেব্রুয়ারীতে বিএনপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচনের পর সংগঠিত আন্দোলনেও মাত্র ১ মাসে ১৭১ জন আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর অবস্থানও বিবেচনায় রাখতে হবে। ’৯৬ সনে দেশীয় জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও ২০২৪-এর নাশকতায় তা ছিল। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান ভিত্তিক জামাত-ই দাওয়া এবং লশকর-ই তৈয়েবা ঘোষণা দিয়ে ইতিমধ্যে বলেছে যে, তারাও ’২৪-এর তথাকথিত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের মাঠে ছিল। তাই এই ঘটনাকে আদোলন না বলে জঙ্গি হামলা বলাটাই যুক্তিযুক্ত।
OHCHR-এর অনুমান, ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত জঙ্গি হামলা সংশ্লিষ্ট মৃত্যুর সংখ্যা ১৪০০ (রিপোর্টের অনুচ্ছেদ – ৫৮)। যেভাবে হিসাব করা হয়েছে তা হল – Para 56.. At the time of finalization of this report, the Ministry of Health has recorded 841 deaths. This data is likely incompolete as medical staff were often overwhelmed by the influx of death and injured, such that a number of cases were not properly recorded. Many families quickly collected the bodies of their loved ones to prevent an autopsy and ensure a quick burial, for religious reasons and out of fear of reprisals for being associated with the protest. National Security Intelligence (NSI) recorded another 314, which were not included in the Ministry of Health data.
সরকারের ২টি সংস্থা প্রদত্ত মৃতের সংখ্যা যোগ করলে হয় ১১৫৫; ১৪০০ নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকা নিশ্চয় সব পোস্টমর্টেমের ভিত্তিতে হয়নি; তাহলে যে সমস্ত নিহত লোকের কথা রিপোর্টে বলা হচ্ছে যারা ভয়ে পোস্টমর্টেম না করিয়ে লাশ হাসপাতাল থেকে নিয়ে গেছে তারা ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে নিহতদের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করায়নি তা কি বিশ্বাস করার কোন কারন আছে, যেখানে এককালীন ৩০ লাখ টাকা অনুদান এবং মাসিক ২০ হাজার টাকা এবং অন্যান্য সুযোগ – সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তাদের ১৪৪ জন নেতাকর্মীর যে হত্যার তথ্য OHCHR- কে দেয়া হয়েছে তাতে ৫ আগস্ট পর্যন্ত যে ৫৮ জনের কথা বলা হয়েছে, তাও এ হিসেবে আনা হয়নি। TOR অনুযায়ী ১৫ আগষ্ট পর্যন্ত মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেয়ার কথা থাকলেও শুধুমাত্র ৫ আগষ্ট পর্যন্ত কেন দেয়া হল তা বোধগম্য নয়।
তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন বলছে মৃতের সংখ্যা ৮৪১ নয়, ৮৩২ জন ; আর সরকারি সংস্থা জুলাই শহীদ ফাউন্ডেশন বলছে শহীদের সংখ্যা ৮২০। যদিও সংবাদমাধ্যম সম্প্রতি অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলছে, এদের মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগে যাত্রাবাড়ীতে পিটিয়ে মেরে ফেলা ৩ জনও আছে। আর এর মধ্য থেকে ৩৫-৪০ জন বেঁচে আছে বলে জানা যাচ্ছে । তাহলে একটা ধারণার বশবর্তী হয়ে কেন OHCHR- কে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে ১৪০০ বলতে হল তা বোধগম্য নয়। তবে OHCHR যে পদ্ধতি অনুসরন করে মৃত্যুর সংখ্যা জানাচ্ছে তা কতটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে সেটা দেখতে হবে।
তারা মূলত সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের তালিকাকে গ্রহন করেছে এবং সরকারের বিভিন্ন ভাষ্য বিশ্বাস করে মৃতের সংখ্যা বলেছে। নিজেরা যাচাই করে দেখেনি। এমনকি হত্যা মামলা হয়েছে ৩৫০-৪০০-এর মত; তাও আবার এক হত্যাকাণ্ডের মামলা একাধিক থানায় হয়েছে, জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়েও হত্যা মামলা হয়েছে। ১৪০০ হত্যা হলে তো ১৪০০-এর কাছাকাছি হত্যা মামলা হওয়ার কথা। বাংলাদেশে গড়ে প্রতিমাসে ৩০০-৩৫০ খুন হয়। জুলাই- আগষ্টে সেই সচরাচর খুনের ঘটনাগুলির তথ্যও এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হয়েছে বলে মনে হয়না। প্রথম আলো পত্রিকা সম্প্রতি রিপোর্ট করেছে, এমন ৬১ জনের নাম শহীদের তালিকায় ঢুকেছে যারা এই তথাকথিত আন্দোলনে মারা যায়নি, অন্য কারণে মারা গিয়েছে।
জুলাই-আগষ্টের জঙ্গি হামলার ঘটনায় প্রায় ১০০%-ই বুলেটের আঘাতে মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু OHCHR- রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, Forensic medical information provided by the Dhaka Medical College Forensic Medicine Department, based on its forensic examination of 130 deaths indicates that more than three-quarters ( 78 percent ) of all deaths were caused by firearms typically wielded by state security forces and not readily available to civilians in Bangladesh. 2% by pistols and 20% by others (Para 61). এই ২০% হত্যা কিভাবে হয়েছে তা বলা দরকার ছিল। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় একটা তালিকা প্রকাশ করেছে যেখানে মৃত্যুর কারণ এবং স্থান উল্লেখ করা হয়নি।
সেখানে পুলিশ বা অন্য কেউ আদৌ গুলি করেছিল কিনা তাও উল্লেখ নাই। যার ফলে OHCHR-কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে দেয়া ১৩০ জনের ছোট স্যাম্পলকে বিবেচনায় নিয়ে হিসেব করতে হয়েছে কতজন কিভাবে মারা গেছে। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লাশের ময়না তদন্ত করা হয়নি। সরকার তা করতে চাইলেও ছাত্র নেতারা তা করতে দেয়নি। এর কারণও রহস্যজনক। OHCHR টিম কেন সরকারকে পরামর্শ দেয়নি লাশ কবর থেকে তুলে ময়না তদন্ত সম্পন্ন করতে। তাহলে কি ধরে নেয়া যায় যে, OHCHR মৃতের সংখ্যা বেশী দেখিয়ে এবং শুধুমাত্র নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সমস্ত হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করে শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে আরও বেশী জনরোষের শিকারে পরিণত করতে চেয়েছে।
এ নাশকতায় যে দেশী-বিদেশী জঙ্গিরাও জড়িত ছিল তাতো তাদের গর্বে ভরা স্বীকারোক্তিতে ফুটে উঠেছে । পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন জামাত-ই দাওয়া ও লস্কর-ই তইয়েবা প্রকাশ্যে দাবী করেছে তারা এ হামলায় বাংলাদেশে অংশগ্রহণ করেছিল। স্বার্থান্বেষী মহল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকেও ভাড়া করে নিয়ে এসেছিল। রায়ের বাজারে যে ১১১-এর অধিক এবং জুরাইন-এ ২০ বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে এরা কারা! এক বছর গত হয়ে গেলেও ১০-১১ জনের বেশী মানুষকে বলতে দেখা যায়নি যে তার সন্তান, ভাই বা বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে বেওয়ারিশ লাশগুলো কি রোহিঙ্গা বা পাকিস্তানি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যদের। বেশ অনেকদিন পূর্বে সরকার হাইকোর্টের নির্দেশের পর বলেছিল, এই লাশগুলো কবর থেকে তুলে DNA Test করে রাখবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ দাবী করলে লাশ তাদেরকে দেয়া যায় বা কবর নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায় । কিন্তু আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর হাজার হাজার মানুষ যাত্রাবাড়ী থানা আক্রমণ করতে গেলে পুলিশ আত্মরক্ষার্তে গুলি চালালে সেখানে ৫০ জনের বেশী মারা যায় বলে বিবিসি-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তেমনিভাবে সাভারের আশুলিয়া থানায়ও একই ঘটনা ঘটে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ৪৫০-এর উপরে থানা আক্রমণ করা হয় এবং পুলিশ সহ বহু লোক হতাহত হয়। এ সমস্ত হত্যাকাণ্ডের দায় কি শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগকে দেয়া যায় ? অথচ গভীরভাবে পর্যালোচনা না করে উদ্দেশ্যমুলকভাবে OHCHR- এর রিপোর্টে এ হামলায় প্রায় সব মৃত্যুর জন্য পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃংখলা বাহিনীকে দায়ী করার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনসমূহ বিশেষ করে ছাত্রলীগকে দায়ী করা হয়েছে।
OHCHR- এর রিপোর্টেই বলা হয়েছে যে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তথা এই নাশকতায় প্রথম যে ২ জনের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে তম্মধ্যে ১ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক। তাহলে এই সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, সরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষা, মানুষের জানমাল রক্ষা বা জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করার প্রয়োজনে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সর্ব সাকুল্যে কয়েক ডজন লোক মারা গিয়েছে, বাকীরা হামলাকারীদের Meticulous design- এর অংশ হিসেবে তাদের নিজেদের হাতেই মারা গিয়েছে অথবা থানা আক্রমণের সময় আত্মরক্ষার্থে পুলিশের এলোপাথাড়ি গুলিতে মারা গিয়েছে।
যশোরে এক আওয়ামী লীগের একটি অভিজাত হোটেল লুট করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের অন্য একটা গ্রুপের দেয়া আগুনে মারা যাওয়া ২৬ জনও নিশ্চয় শহীদের( ? ) তালিকায় স্থান পেয়েছে। OHCHR-এর অনুসন্ধানী দল ভালভাবে যাচাই না করে ইউনুস সরকারকে খুশী করতে ১৪০০ জনের মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখ করেছে এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কারণ নেই। হাস্যকর বিষয় এই যে, জাতিসংঘের মনগড়া ১৪০০ জনের মৃত্যুর প্রসঙ্গ বারবার টেনে এনে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে তার দায়ভার দিয়ে তাকে এবং তার দলের নেতাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সরকারের তৈরি করা রায় দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলানোর চেষ্টা করছে এবং তাকে ও তার দলকে বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি নেপালে যে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার উৎখাত করা হল, সে আন্দোলনে ৭১ জন হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা নেপালের জনসংখ্যার ৮ গুণ। সে হিসেবে তুলনা করলে মাত্র ৩-৪ দিনের আন্দোলনে নেপালেই তুলনামুলকভাবে বেশী মানুষ হত্যা হয়েছে। তারপরও নেপালের অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিহিংসার পরিবর্তে জাতীয় সংহতিকে জোরালো করার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর বাংলাদেশে ডঃ ইউনুস সরকার জাতিকে ক্রমাগতভাবে বিভক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

