চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে দিনের বেলা একজন সরকারি কর্মকর্তার গাড়িতে সন্ত্রাসী হামলা হলো। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে এসে কাস্টমস কর্মকর্তা আসাদুজ্জামানের গাড়ির কাঁচ ভাঙল দুর্বৃত্তরা। “গুলি কর” বলে চিৎকার করল একে অপরকে। শুধু চালকের দ্রুত বুদ্ধিতে প্রাণে বেঁচে গেলেন কর্মকর্তা। এই ঘটনা যদি স্বাভাবিক মনে হয়, তাহলে বুঝতে হবে দেশ কোন অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে।
জুলাইয়ের সহিংস দাঙ্গার পর যে তথাকথিত “নতুন বাংলাদেশ” গড়ার স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, তার বাস্তবতা এখন রাস্তায় রাস্তায় দৃশ্যমান। একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তাদের আমলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে একজন রাজস্ব কর্মকর্তা অফিস থেকে ফেরার পথে প্রাণের ভয়ে থাকেন। প্রশ্ন হলো, এই কি সেই গণতন্ত্র যার জন্য রক্ত ঝরানো হলো? এই কি সেই সংস্কার যার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল?
মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসেছে অসাংবিধানিক পথে। বিদেশি শক্তির মদদ, চরমপন্থী গোষ্ঠীর সহযোগিতা এবং সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সমর্থনে গঠিত এই প্রশাসন দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা এখন পরিষ্কার। শান্তিতে নোবেল পাওয়া একজন মানুষের নেতৃত্বে দেশে শান্তি নেই, নিরাপত্তা নেই, আইনের শাসন নেই। বরং প্রতিদিন নতুন নতুন অপরাধের খবর আসছে। সন্ত্রাসীরা এখন প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়িতে হামলা চালাচ্ছে।
আসাদুজ্জামানের মতো একজন দায়িত্বশীল সরকারি কর্মচারী তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হন। তিনি কোনো রাজনীতিবিদ নন, কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি নন। তিনি একজন রাজস্ব কর্মকর্তা যিনি রাষ্ট্রের জন্য কাজ করেন। তার ওপর এই আক্রমণ প্রমাণ করে যে এই দেশে এখন আর কেউই নিরাপদ নন। ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাধারণ নাগরিক কিংবা সরকারি কর্মচারী সবাই এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
যে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ, সেই সরকারের নৈতিক অধিকার থাকে না ক্ষমতায় থাকার। ইউনূস সরকার ক্ষমতায় এসেছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ভেঙে। তাদের কোনো গণভিত্তি নেই, কোনো নির্বাচনী ম্যান্ডেট নেই। তারা শুধু টিকে আছে বহিঃশক্তির মদদে এবং একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি টিকিয়ে রেখে। এই অস্থিতিশীলতার সুযোগে সন্ত্রাসীরা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। অপরাধীরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
চট্টগ্রামের মতো একটি প্রধান বাণিজ্যিক শহরে এমন ঘটনা ঘটা মানে পুরো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, যেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষ যাতায়াত করেন। সেখানে দিনের বেলা, সকাল দশটায় এমন সাহসী হামলা চালানোর সাহস পায় অপরাধীরা। এর অর্থ হলো তারা নিশ্চিত যে তাদের কোনো শাস্তি হবে না। তাদের এই আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে আসে? কারা তাদের এই সাহস জোগায়?
জুলাইয়ের সেই রক্তাক্ত দিনগুলোতে যারা রাস্তায় নেমেছিল, তাদের অনেকেই হয়তো সত্যিই বিশ্বাস করেছিল যে তারা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ছে। কিন্তু আজ সেই ভবিষ্যতের চেহারা কী? রাস্তায় সন্ত্রাস, প্রশাসনে অরাজকতা, অর্থনীতিতে মন্দা, আর সাধারণ মানুষের জীবনে নিরাপত্তাহীনতা। মাইক্রোক্রেডিটের জগতে সুদের ব্যবসা করে নোবেল পাওয়া একজন ব্যক্তি এখন পুরো দেশকে তার পরীক্ষাগারে পরিণত করেছেন। কিন্তু এই পরীক্ষা চলছে সাধারণ মানুষের রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে।
কাস্টমস কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বেঁচে গেছেন ভাগ্যক্রমে। কিন্তু কতজন এভাবে বেঁচে যাবেন? পরের বার হয়তো কেউ ততটা ভাগ্যবান হবেন না। এই সরকারের কাছে তার জবাবদিহিতা কী? তারা কি শুধু বিবৃতি দিয়ে, তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়িত্ব শেষ করবেন? নাকি তারা সত্যিই জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম?
বাস্তবতা হলো, যে সরকার নিজেই অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছে, তারা কীভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে? যে সরকারের ভিত্তি দাঙ্গা আর রক্তপাতের ওপর দাঁড়িয়ে, তারা কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে? যে সরকার বিদেশি শক্তির প্রতি দায়বদ্ধ, তারা কীভাবে দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে?
চট্টগ্রামের এই ঘটনা একটি লক্ষণমাত্র। সারাদেশে এরকম অগণিত ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। কিছু হয়তো মিডিয়ায় আসছে, অনেক ঘটনা চাপা পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিটি ঘটনা বলে দিচ্ছে যে এই দেশ এখন অরক্ষিত। প্রতিটি নাগরিক এখন ঝুঁকির মধ্যে। ইউনূস এবং তার দল যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, ততদিন এই অবস্থা চলতে থাকবে। কারণ তাদের লক্ষ্য দেশের উন্নতি নয়, তাদের লক্ষ্য একটি বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা। আর সেই এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য দেশকে অস্থিতিশীল রাখাই তাদের কৌশল।
আসাদুজ্জামান আজ বেঁচে গেছেন। কিন্তু আগামীকাল কে বাঁচবে, কে বাঁচবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশ চলছে। আর এই অনিশ্চয়তার জন্য দায়ী তারাই যারা একটি নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতা দখল করেছে।

