জুলাইয়ের রক্তাক্ত দাঙ্গা আর নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বসা মুহাম্মদ ইউনুসের তথাকথিত সরকার এখন দেখাচ্ছে তাদের আসল চেহারা। যে সরকার গণতন্ত্র, মানবাধিকার আর জনগণের কল্যাণের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছিল, সেই সরকারই এখন নিরীহ প্রাথমিক শিক্ষকদের উপর চালাচ্ছে নির্মম অত্যাচার। যাদের দোষ শুধু এটুকুই যে তারা নিজেদের ন্যায্য তিন দফা দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করেছিলেন।
দেশের জাতি গঠনের কারিগর যে শিক্ষকরা, যারা প্রতিদিন স্বল্প বেতনে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার কাজ করে যাচ্ছেন, তাদেরকেই এখন শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। পাঁচশ থেকে সাড়ে পাঁচশ শিক্ষককে হঠাৎ করে তাদের নিজ জেলা থেকে উৎখাত করে ভিন্ন জেলায় বদলি করে দেওয়া হয়েছে। শুধু নোয়াখালী জেলাতেই চল্লিশজন শিক্ষককে এই শাস্তিমূলক বদলির শিকার হতে হয়েছে। প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে যে বদলি করা হয়েছে, সেটা আসলে কোনো গোপন বিষয় নয়। এটা পরিষ্কার প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষক নেতাদেরকে বিশেষভাবে টার্গেট করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের অন্যতম আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামছুদ্দিন মাসুদকে নোয়াখালী থেকে লক্ষ্মীপুরে বদলি করা হয়েছে। এই বদলির মানে কী? একজন শিক্ষককে তার পরিবার, সন্তান, আত্মীয়স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে অন্য জেলায় পাঠিয়ে দেওয়া। তাকে নতুন করে ঘরবাড়ি, সন্তানদের স্কুল, সব কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। যে শিক্ষকরা মাসে পনেরো থেকে বিশ হাজার টাকা বেতন পান, তাদের জন্য এটা কতটা কষ্টকর হবে সেটা কি ইউনুসের সরকার বোঝে না, নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছে?
যে সরকারের জন্ম হয়েছিল বিদেশি শক্তির টাকা, ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের সহায়তা আর সামরিক বাহিনীর মদদে, সেই সরকার কীভাবে জনগণের কল্যাণ করবে? জুলাই মাসে যে দাঙ্গা বাঁধানো হয়েছিল, যেখানে শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, সেই রক্তের উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটা অবৈধ সরকার কীভাবে ন্যায়বিচার দেবে? তারা তো এসেছিলই জনগণের নির্বাচিত সরকারকে ক্যু করে ক্ষমতা দখল করতে। এখন সেই একই কায়দায় তারা শিক্ষকদের উপর চালাচ্ছে দমননীতি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কখনোই এক জেলা থেকে অন্য জেলায় বদলি হন না। এটা একটা প্রতিষ্ঠিত নিয়ম। কিন্তু শাস্তিমূলক বদলির সময় এই নিয়ম ভাঙা হয়। আর এবার যে পাঁচশোর বেশি শিক্ষককে এভাবে বদলি করা হয়েছে, সেটা পরিষ্কার বার্তা দিচ্ছে যে ইউনুসের সরকার আন্দোলন সহ্য করবে না। যারা তাদের ন্যায্য অধিকার চাইবে, তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষকদের দাবি কি অন্যায় ছিল? তারা কি দেশবিরোধী কিছু চেয়েছিলেন? তারা শুধু চেয়েছিলেন তাদের বেতন কাঠামোর উন্নয়ন, চাকরির নিরাপত্তা আর কিছু ন্যায্য সুবিধা। যে দেশের শিক্ষকরা মর্যাদা পাবে না, যে দেশে শিক্ষকদের দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করলে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে, সে দেশে শিক্ষার মান কীভাবে উন্নত হবে? যে শিক্ষক নিজের পরিবার নিয়ে স্বস্তিতে থাকতে পারেন না, তিনি কীভাবে শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে পড়াবেন?
সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা যখন এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তখন তারা স্পষ্ট করে বলতে পারেননি ঠিক কতজনকে বদলি করা হয়েছে। প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে বদলি করা হয়েছে বললেও সেই কারণগুলো কী, সেটা কেউ বলছে না। এটা তো পরিষ্কার যে এই বদলি একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, প্রশাসনিক নয়।
ইউনুসের এই অবৈধ সরকার যেভাবে শিক্ষকদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে, সেটা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষার ভিত্তি। যে ভিত্তি দুর্বল, সেই দালান কখনো শক্তিশালী হতে পারে না। আর এই ভিত্তি গড়ে দেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তাদেরকে এভাবে হয়রানি করলে, তাদের মনোবল ভেঙে দিলে, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে সরকার ক্ষমতায় এসেছিল গণতন্ত্র আর জনগণের অধিকারের কথা বলে, সেই সরকারই এখন জনগণের সেবক শিক্ষকদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। যে সরকার বলেছিল তারা সবার কথা শুনবে, সবার দাবি মানবে, সেই সরকারই এখন আন্দোলনকারীদের শাস্তি দিচ্ছে। এর চেয়ে বড় ভণ্ডামি আর কী হতে পারে?

