লালদিয়া টার্মিনাল চুক্তির খসড়া হাতে এসেছে। পড়তে পড়তে চোখ কপালে উঠে যায়। এই চুক্তিটা আসলে চুক্তি নয়, আত্মসমর্পণ দলিল। ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালস যে সুবিধা আদায় করে নিয়েছে, তা দেখলে মনে হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র নয়, কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান।
বন্দর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্ণফুলী মোহনার লালদিয়ার অবস্থান এমন যে এটি স্বাভাবিকভাবেই চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে ব্যস্ত টার্মিনালে পরিণত হবে। গুপ্তবাঁকের ঠিক আগে, জাহাজ আসা-যাওয়ার জন্য আদর্শ জায়গা। সরকারি হিসেবে বছরে দশ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের কথা বলা হলেও বাস্তবে এর পরিমাণ হবে আরো বেশি। এই সোনার খনির মতো জায়গাটা তুলে দেওয়া হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির হাতে, আর শর্তগুলো এমন যে দেশ পাবে চিনেবাদাম, আর তারা নিয়ে যাবে পুরো ফসল।
প্রথম কথা হলো সময়সীমা। সরকারিভাবে বলা হয়েছিল তেত্রিশ বছরের চুক্তি। কিন্তু চুক্তির নথিতে স্পষ্ট লেখা আছে আটচল্লিশ বছর। তিন বছর নির্মাণ, ত্রিশ বছর পরিচালনা, আর পনেরো বছর বাড়তি মেয়াদ। এই পনেরো বছরের ব্যাপারে ইংরেজিতে লেখা আছে ‘ফিফটিন ইয়ার্স মাস্ট বি এক্সটেন্ডেবল’। মানে এটা ঐচ্ছিক নয়, বাধ্যতামূলক। বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী এ ধরনের চুক্তি হয় বিশ থেকে পঁচিশ বছরের। পতেঙ্গার টার্মিনালে সৌদি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল বাইশ বছরের। কিন্তু লালদিয়ায় দেওয়া হলো আটচল্লিশ বছর। প্রায় অর্ধশতক। এই সময়ের মধ্যে পৃথিবী পাল্টে যায়, প্রযুক্তি বদলে যায়, বাজার বদলে যায়। কিন্তু লালদিয়া থাকবে এপিএম টার্মিনালসের হাতে, অপরিবর্তিত শর্তে।
এবার আসা যাক টাকার হিসাবে। পতেঙ্গা টার্মিনালে চট্টগ্রাম বন্দর পায় প্রতি টিইইউতে আঠারো ডলার। লালদিয়ায় প্রথম স্ল্যাবে পাবে একুশ ডলার, দ্বিতীয় স্ল্যাবে বাইশ ডলার। শুনতে ভালো লাগছে তো? কিন্তু এখানেই আসল ফাঁদ লুকিয়ে আছে। চুক্তিতে আছে তৃতীয় একটা স্ল্যাব, যার কথা সরকারি কোনো প্রচারণায় একবারও বলা হয়নি। বছরে নয় লাখ টিইইউ পার হলেই বাড়তি প্রতিটি কনটেইনারে বন্দর পাবে মাত্র দশ ডলার। মানে যত বেশি ব্যবসা হবে, বন্দরের আয় তত কমবে। আর লালদিয়ার অবস্থান আর এপিএম টার্মিনালসের বাজার নিয়ন্ত্রণ দেখলে বোঝা যায়, এই তৃতীয় স্ল্যাবটাই হবে আসল বাস্তবতা।
মায়ের্সক গ্রুপের এপিএম টার্মিনালসের নিজস্ব শিপিং লাইন আছে, কনটেইনার আছে। চট্টগ্রাম বন্দরে তাদের ব্যবসা এখনই সবচেয়ে বড়। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে মায়ের্সকের আধিপত্য প্রায় একচেটিয়া। তাদের নিজস্ভ টার্মিনাল হলে তাদের জাহাজ পাবে অগ্রাধিকার। টার্মিনালে জট হলেও তাদের জাহাজ অলস বসে থাকার জন্য দিনে দশ থেকে পনেরো হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। এই সাশ্রয়ের হিসাব কোথাও নেই। তারা যদি সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে কনটেইনার সেবা চালু করে, তাহলে তাদের পরোক্ষ মুনাফা হবে বহুগুণ। এগুলো চুক্তির বাইরের লাভ, যা বাংলাদেশ কখনো দেখবেও না।
চুক্তি অনুযায়ী এপিএম টার্মিনালস তাদের বিনিয়োগ তুলে নেবে মাত্র এগারো বছরে। বাইশ বছরের পতেঙ্গা চুক্তিতে এই পে-ব্যাক পিরিয়ড ছিল তেরো বছর। মানে লালদিয়ায় তারা দ্রুত বিনিয়োগ উঠিয়ে নেবে, তারপর বাকি সাঁইত্রিশ বছর হবে নিট মুনাফা কাটার সময়। আর বাংলাদেশ পাবে তাদের নির্ধারিত ফর্মুলা অনুযায়ী সীমিত রাজস্ব, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো কমবে।
আপফ্রন্ট ফির ব্যাপারটা আরো বিস্ময়কর। পতেঙ্গায় সৌদি কোম্পানি চুক্তির দিনই দুই কোটি ডলার জমা দিয়েছিল। এই টাকা বন্দর ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছে, প্রতিদিন সুদ পাচ্ছে। লালদিয়ায় একই পরিমাণ আপফ্রন্ট ফি ধার্য করা হলেও এখনো এক টাকাও জমা পড়েনি। বলা হচ্ছে চুক্তি কার্যকরের সময় অর্ধেক, বাকি অর্ধেক অপারেশন শুরুর পর। পানগাঁও নৌ-টার্মিনালের চুক্তিতে মেডলগ একই দিনে আঠারো কোটি টাকা জমা দিয়েছে। কিন্তু লালদিয়ায় এই সৌজন্য দেখানো হলো কেন?
আরো মজার ব্যাপার হলো লোকাল পার্টনার নিয়ে। সৌদি আর তুর্কি কোম্পানি তাদের বাংলাদেশি সহযোগীর ব্যাপারে স্পষ্ট করে বলেছে যে যেকোনো দায়দেনা, ক্ষতিপূরণ তারা নিজেরাই বহন করবে। দায়দায়িত্বের বিষয়ে চুক্তিতে কিছুই পরিষ্কার নয়। কোনো সমস্যা হলে কে দায় নেবে, তা এখনো অস্পষ্ট।
লালদিয়া চুক্তিতে বার্ষিক নির্ধারিত কোনো ফি নেই। পতেঙ্গায় আছে। এটা কেন বাদ দেওয়া হলো? আটচল্লিশ বছরের দীর্ঘ চুক্তিতে বার্ষিক ফি না রাখা মানে বন্দরের জন্য নিয়মিত আয়ের একটা বড় উৎস থেকে বঞ্চিত হওয়া।
যারা এই চুক্তি করেছেন, তারা হয় এর জটিলতা বোঝেননি, নয়তো বুঝেও এড়িয়ে গেছেন। বন্দর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেগোসিয়েশনে সমান শর্ত আদায় করতে পারেনি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। পতেঙ্গায় যেখানে শক্ত অবস্থান নিয়ে উইন-উইন কাঠামো নিশ্চিত করা হয়েছিল, লালদিয়ায় সেই দৃঢ়তা অনুপস্থিত।
প্রশ্ন হলো, এত তাড়াহুড়ো কেন? কেন দেশীয় বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক দল, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা হলো না? কেন চুক্তির এত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত গোপন রাখা হলো? তৃতীয় স্ল্যাবের কথা কেন সরকারি প্রচারণায় আসেনি?
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ঠিকই বলেছেন, এ ধরনের চুক্তিতে যাওয়ার আগে যাদের অভিজ্ঞতা আছে তাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করা উচিত ছিল। চুক্তির শর্তগুলো গোপন রাখতে চাওয়ার মধ্যেই সন্দেহের জায়গা তৈরি হয়। জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হয়েছে কিনা, সেই প্রশ্ন এড়ানো যায় না। দেশের আয় কত হওয়া যৌক্তিক, স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে কিনা, এসব প্রশ্নের জবাব চাওয়া মানুষের অধিকার।
এত বড় একটা চুক্তি, যা দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, তা নিয়ে জনমত যাচাই না করে, বিশেষজ্ঞ মতামত না নিয়ে, রাতারাতি করে ফেলা হয়েছে।
পুরো বিষয়টা দেখলে মনে হয়, ক্ষমতায় আসার পেছনে যে উদ্দেশ্য ছিল, তা পূরণ হচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে। দেশের সম্পদ, দেশের সুবিধা, দেশের ভবিষ্যৎ তুলে দেওয়া হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির হাতে, আর শর্তগুলো এমন যে আগামী প্রজন্ম এই ভার বইবে।
লালদিয়া টার্মিনাল হবে চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে ব্যস্ত, সবচেয়ে লাভজনক টার্মিনাল। এর নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত ছিল বাংলাদেশের হাতে। অথবা এমন শর্তে যে দেশ তার ন্যায্য অংশ পাবে। কিন্তু যা হয়েছে তা হলো একতরফা আত্মসমর্পণ। বাংলাদেশ দেবে জমি, দেবে সুবিধা, দেবে বাজার। আর পাবে ফর্মুলাবদ্ধ সীমিত রাজস্ব, যা কনটেইনার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকবে।
এই চুক্তি শুধু একটা টার্মিনালের চুক্তি নয়। এটা একটা নমুনা। দেশের সম্পদ কীভাবে হস্তান্তর করা হচ্ছে, তার উদাহরণ। যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের কাছে প্রশ্ন, এই চুক্তি কি জনগণের স্বার্থে? নাকি অন্য কোনো প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য? চুক্তির গোপন শর্তগুলো প্রকাশ করা হোক। জনগণ জানুক, দেশ কী হারাচ্ছে আর কী পাচ্ছে। তাহলেই স্পষ্ট হবে, এই সরকার কার স্বার্থ রক্ষা করছে।

