বাংলাদেশ তার সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যে প্রক্রিয়াটি একটি স্বাভাবিক রূপান্তরপর্ব হওয়ার কথা ছিল, সেটাই এখন ধীরে ধীরে দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে ক্ষয় করে দেওয়ার পথে এগোচ্ছে। ২০২৪ সালের আগস্টে ক্ষমতা গ্রহণের পর মুহাম্মদ ইউনূস এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলেন, যা পুরো পরিস্থিতিকে আমূল বদলে দিয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেছেন, যার ফলে দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটার কার্যত আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
একটি মাত্র আদেশেই আসন্ন জাতীয় নির্বাচন তার স্বাভাবিক অর্থ বহন করছে না; বরং তা ক্রমেই রূপ নিচ্ছে একটি সচেতনভাবে মঞ্চস্থ করা প্রহসনে। যার উদ্দেশ্য বড় একটি দলকে প্রতিযোগিতা থেকে বাইরে রাখা।
এটা কোনো আকস্মিক ঘটনা বা ভুল বোঝাবুঝি নয়—বরং একটি সুস্পষ্ট ধারাবাহিকতার অংশ। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তিকে যখন পাশ কাটিয়ে রাখা হচ্ছে, তখন জামায়াতে ইসলামীর মতো উগ্র গোষ্ঠীগুলো এমন মাত্রার প্রভাব ও সুযোগ পাচ্ছে, যা তারা বহু বছর ধরে পায়নি। একই সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, জনজীবনে “নৈতিক পুলিশিংয়ের” স্বাভাবিকীকরণ এখন গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে এমন এক পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, যা অস্বস্তিকর। দেশে জঙ্গিবাদ উচ্চবাচ্য করে রাস্তায় দেখা যাচ্ছে না বরং এক নরম, নীরব সংস্করণের মধ্যে তা হচ্ছে। আর এর শুরু হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর মাধ্যমে। এভাবে বাংলাদেশ যেন বাস্তবেই এক ধরনের জঙ্গি রাষ্ট্রে রূপান্তরের দিকে এগোচ্ছে—ধীরে, নীরবে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে।
ইউনূস যখন আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম স্থগিত করলেন, সেটি কোনো সাধারণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ছিল না; বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ব্ল্যাকআউট। একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তিনি দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিকে কার্যত নিঃশব্দ করে দিয়েছেন, এবং প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটারের মতামৎকে বাদ দিয়েছেন কোনো বিতর্ক ছাড়াই, কোনো ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়া ছাড়াই, কোনো জনাধিকার ছাড়াই। শুধুই অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার প্রয়োগের মাধ্যমে।
এ ধরনের কৌশল সাধারণত সেইসব শাসনব্যবস্থায় দেখা যায়, যাদের আসল প্রতিদ্বন্দ্বিতাই সবচেয়ে বড় ভয়। আফগানিস্তানে তালিবানরা জনগণের আস্থা অর্জন করে বিরোধীদের সরিয়ে দেয়নি; বরং প্রতিদ্বন্দ্বী দল নিষিদ্ধ করে, রাজনৈতিক সংগঠন সংকুচিত করে, এবং যে সম্প্রদায়গুলো তাদের শাসন মানতে চাননি, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। ইউনূস হয়তো বন্দুকের ক্ষমতা ব্যবহার করছেন না, কিন্তু পদ্ধতিগত দিক থেকে তুলনা করলে মিলটা ভয়ংকরভাবে স্পষ্ট: প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে ফেলো, তারপর রাজনৈতিক মাঠকে “উন্মুক্ত” ঘোষণা করো কিন্তু তা কেবল নিয়ন্ত্রিত গোষ্ঠীদের জন্য।
আওয়ামী লীগকে পাশে সরিয়ে রেখে ইউনূস এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে চাইছেন, যেখানে নির্বাচনের ফলাফল আগেই নির্ধারিত থাকে। এটি সেই পরিচিত স্বৈরাচারী যুক্তিরই প্রতিফলন: যদি প্রতিপক্ষকে ভোটে হারানো না যায়, তবে তাদের সরিয়ে দাও খেলার মাঠ থেকেই।
জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে না এ তথ্য তিনি যুক্তরাজ্যের এক মন্ত্রীকেও জানিয়েছেন বলে জানা যায়।
আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়ার পরিণতি অত্যন্ত গভীর। যখন দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ কার্যত তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষমতা হারায়, তখন নির্বাচন তার মৌলিক অর্থ হারিয়ে ফেলে। গণতন্ত্র তখন রূপ নেয় এক ধরনের মঞ্চস্থ রাজনৈতিক নাটকে। রাষ্ট্রও তখন আর বহুত্ববাদী প্রজাতন্ত্রের মতো দেখায় না; বরং ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, বিরোধীদের নীরব করা এবং জনসম্মতি ছাড়াই সমাজকে পুনর্গঠন—এই অগণতান্ত্রিক প্রবৃত্তিগুলোর প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। যা তালেবানি শাসনের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে অস্বস্তিকর মিল বহন করে।
এই নির্বাহী আদেশ শুধু একটি রাজনৈতিক দলের ওপর আঘাত নয়; এটি গণতান্ত্রিক পছন্দের মৌলিক ধারণার ওপর আঘাত। এবং এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে স্পষ্ট সংকেতগুলোর একটি যে, ইউনূস বাংলাদেশকে এমন এক রাজনৈতিক মডেলের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, যার বৈশিষ্ট্য ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চেয়ে উগ্রপন্থীদের শাসনের সঙ্গে বেশি মেলে। সেই মূল্যবোধের সাথে নয়, যার জন্য এই দেশের মানুষ লড়াই করে এসেছে।
যখন ইউনূস লাখ লাখ মানুষকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিচ্ছেন, তখন তিনি টেনে আনছেন ঠিক সেই শক্তিগুলোকে, যাদের বাংলাদেশ বহু বছর ধরে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে এসেছে। জনসমর্থনের ঘাটতি পূরণ করতে তিনি জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য চরমপন্থী নেটওয়ার্ককে তার নতুন রাজনৈতিক ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ উঠছে। একসময় সহিংসতা ও চরমপন্থী এজেন্ডার জন্য সীমাবদ্ধ এই গোষ্ঠীগুলো এখন ইউনূসের রাজনৈতিক সমর্থনের বিনিময়ে নতুন ধরনের বৈধতা, স্বাধীনতা এবং সুরক্ষা লাভ করছে।
বাংলাদেশে কীভাবে ইউনূস চরমপন্থীদের কাছে পৌঁছালেন—তাই এখন নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। রাষ্ট্রের ভেতরে পরিবর্তন এখন স্পষ্টতই দৃশ্যমান। ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসকদের অপসারণ করা হচ্ছে, আর জঙ্গি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ পদে উঠে আসছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও যেন অগ্রাধিকার বদলে ফেলেছে: একসময় যারা সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে হামলা চালাতো, সেই উগ্রপন্থীদের প্রতি নজরদারি শিথিল; অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের প্রতি কঠোর আচরণ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষমতার নতুন সমীকরণ তাই স্পষ্ট—রাষ্ট্রকে এমনভাবে পুনর্গঠন করা হচ্ছে, যা ইউনূসের জঙ্গি মিত্রদের স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এর সামাজিক পরিণতিও এখন পরিষ্কার হয়ে উঠছে। ধর্মনিরপেক্ষ গণমাধ্যম, শিক্ষাবিদ ও নারী অধিকারের ওপর হামলা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। নারীদের খেলাধুলা বাতিল করা, নৈতিক পুলিশিংয়ের উত্থান, এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিধিনিষেধ আরোপ—এসব মিলিয়ে বোঝা যায় চরমপন্থী মতাদর্শ কীভাবে অল্প অল্প করে, নীরবে, দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করছে।
দেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র একদিনে বানানো যায় না। এটি গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে—উগ্রপন্থীদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা, রাষ্ট্রযন্ত্রের নীরব পুনর্দখল, আর সামাজিক স্বাধীনতার ক্রমশ সংকোচনের মাধ্যমে। ইউনূস কেবল এই উগ্র গোষ্ঠীগুলোকে সহ্য করছেন না; বরং তাদের এক ধরনের ক্ষমতা দিচ্ছেন । ফলে বাংলাদেশ এখন এমন এক ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে বলে মনে হতে পারে, যা ভয়ঙ্করভাবে তালিবান-ধাঁচের শাসনের প্রতিচ্ছবি বহন করে।
আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বাদ দিয়ে ইউনূস আসন্ন নির্বাচনকে কার্যত একটি আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করেছেন। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিকে সরিয়ে দেওয়ার ফলে ফলাফল আগেভাগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে, আর সেই শূন্যস্থান ব্যবহার করছে উগ্রপন্থী শক্তিগুলো। এভাবে একটি বাহ্যিকভাবে গণতান্ত্রিক কিন্তু ভেতরে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি হচ্ছে যেখানে নির্বাচন নামমাত্র থাকবে, কিন্তু ক্ষমতার প্রকৃত রূপ আগে থেকেই স্থির থাকবে।
এই পরিস্থিতির মাশুলও চরমভাবে দিতে হবে। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয় এখন বিপজ্জনকভাবে দুর্বল অবস্থানে। উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো রাজনৈতিক ক্ষেত্র ও জনপরিসরে নতুন স্থান অর্জন করছে, অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, ব্যক্তিস্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নতুন ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন। এই অস্থিরতা শুধু দেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও চাপ তৈরি করছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থানকেও কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলছে।
ইউনূস দেশকে এমন এক বিপজ্জনক সীমান্তে এনে দাঁড় করিয়েছেন, যেখানে শুধু ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন অপেক্ষা করছে না। হয়তো আরও অপেক্ষা করছে ভয় দেখানো ও মনোনীত শক্তিগুলোর পক্ষে সাজানো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এক উদ্বেগজনক ভবিষ্যৎ।

