আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) বাংলাদেশের ন্যায়বিচারের ইতিহাসে এক প্রতীকী প্রতিষ্ঠান। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠিত এই ট্রাইব্যুনাল বহুদিন ধরে ন্যায়বিচারের মানদণ্ড হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সম্প্রতি ঘটা ঘটনাগুলো এই প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা, কার্যকারিতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে। একাধিক সূত্র, পর্যবেক্ষক ও সংশ্লিষ্ট মহলের কথায় ট্রাইব্যুনাল আজ নিজেই বিচারের আড়ালে প্রহসনের দৃশ্য তুলে ধরছে।
চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তুজা ১৩ নভেম্বরের আগে প্রায় এক মাস ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন না এমন তথ্য আদালত-সংশ্লিষ্টরা তুলে ধরছেন। এত দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালের নিয়মিত কার্যক্রম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তিনজন বিচারপতি একসঙ্গে বসে শুনানি ও রায় দেওয়ার যে কাঠামো, সেটি কার্যত অকার্যকর হয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে—চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকায় অন্য দুই বিচারপতি আলাদাভাবে সকাল ও বিকেলে শুনানি পরিচালনা করতে বাধ্য হন। ফলে ট্রাইব্যুনালের গঠনতান্ত্রিক উদ্দেশ্য, সমন্বিত বিচার-প্রক্রিয়া এবং রায় প্রদানের ন্যায্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
অভিযোগ আরও গুরুতর। বলা হচ্ছে, চেয়ারম্যান নাকি আদালতে না এসেও বাড়িতে বসে রায় প্রস্তুত করছেন। এটি যদি সত্য হয়, তবে এটি বিচারিক প্রক্রিয়ার সরাসরি ব্যত্যয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে বিচারকের উপস্থিতি, শুনানিতে অংশগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শোনা—এগুলো রায় দেওয়ার অপরিহার্য অংশ। কিন্তু উপস্থিতি ছাড়াই রায় প্রণয়ন করা হলে সেটি আইনি কাঠামো, ন্যায়বিচারের নীতি এবং বিচারিক নৈতিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়।
যা আরও উদ্বেগজনক, এসব অনিয়ম নিয়ে ট্রাইব্যুনাল বা প্রশাসন থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা বা স্পষ্টীকরণ পাওয়া যায়নি। দায়বদ্ধতার এই অভাবই অসচ্ছতার চিত্রকে আরও প্রকট করে তুলছে। সাধারণ মানুষের আস্থা, মানবাধিকার সংগঠনের প্রশ্ন এবং আইনজীবী মহলের উদ্বেগ সবকিছু মিলিয়ে ট্রাইব্যুনালের অবস্থান এখন আলোচনার কেন্দ্রে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচারপতির অনুপস্থিতি ও অসম্পূর্ণ বেঞ্চে শোনানি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তো দূরের কথা—দেশীয় আইনের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আদালতকে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়, আর বিচারকের অনুপস্থিতি বা বাইরে থেকে রায় লেখার অভিযোগ সেই প্রতীকের ভিত্তি নড়বড়ে করে। এতে শুধু রায়ের গ্রহণযোগ্যতাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, পুরো বিচারব্যবস্থার মর্যাদাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
ট্রাইব্যুনালের নামে পরিচালিত বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে জনগণের দ্বিধা-দ্বন্দ্বও বেড়েছে। যেসব মামলায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, সেসব মামলার রায় স্বচ্ছতা ও নিয়ম অনুযায়ী না হলে ন্যায়বিচার পাওয়া মানুষদের কাছেও তা অস্পষ্ট থেকে যায়। আর বিচারকেরা যদি নিজেরাই আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ হন, তাহলে সাধারণ মানুষের আস্থা কোথায় দাঁড়াবে?
সব মিলিয়ে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাম্প্রতিক চিত্র এক গভীর অসচ্ছতা, প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও অনিয়মের প্রতিচ্ছবি। আদালতে অনুপস্থিতি, অসম্পূর্ণ বেঞ্চে শোনানি, বাইরে রায় লেখার মতো অভিযোগ এসবই বিচারের আড়ালে এক প্রহসনের ছবি ফুটিয়ে তুলছে। যে ট্রাইব্যুনাল একসময় ন্যায়বিচারের প্রতীক ছিল, আজ সেই প্রতিষ্ঠানই প্রশ্নের মুখে।
এখানে যে সংকেত স্পষ্ট আইনের শাসন এবং বিচারব্যবস্থার মর্যাদা তখনই টিকে থাকে, যখন বিচার-প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও নিয়মমাফিক হয়। আর যখন সেই স্বচ্ছতা ভেঙে যায়, তখন বিচার আর বিচার থাকে না প্রতীকী পর্যায়ে নামমাত্র প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়।

